পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
সাম্প্রতিক একটি ঘটনা। আমরা সবাই জানি। কিন্তু,তারপর অনেক কথা,অনেক জিজ্ঞাসা ঘুরে বেড়ায়,কেউ মনে রাখি,কেউ মনে রাখিনা।
কি সেই ঘটনা?
“মা আমি চুরি করিনি”–সিসি ক্যামেরাতেও দেখা গেল,সেই সত্য-কে,– ছোট্ট ছেলেটা আমাদের এই চলমান সমাজ-ব্যবস্থার মুখের ওপরে একটা বিরাট মৌন মুখর প্রশ্ন (?) চিহ্ন রেখে দিয়ে আমাদের প্রতি একরাশ ঘৃণা ছুঁড়ে৷ দিয়ে, পাড়ি দিল না ফেরার দেশে।
অপবাদ, অমূলক সন্দেহ,অহেতুক দোষী সাব্যস্ত করা, এইসব সামাজিক-মানসিক ব্যাধি যে আজ মহামারীর মতো আকার ধারণ করেছে,সে কথা আজ কেউই অস্বীকার করতে পারিনা।
বছর চোদ্দ-র এক কিশোর মানুষকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগটুকু না দিয়ে,তার প্রতি অন্যায় অত্যাচার,অবিচার করা হোল।অতটুকু বয়সে সে প্রতিকুল অবস্থায় নিজেকে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল না তার,তাই সে বেছে নিল আত্মহননের পথ।কি ছিল ঘটনা? ৫টাকার একটা কুড়কুড়ের প্যাকেট একটা দোকানের সামনে রাস্তায় পড়েছিল।ছেলেটা সেটা কুড়িয়ে নেয়। দোকানী তখন সেই রাস্তায় পড়ে থাকা প্যাকেট তার বলে দাবী করে,এবং ছেলেটাকে চোরের অপবাদ দেয়।ছেলেটা যতই বলেছে,না ওটা রাস্তায় পড়েছিল,আমি চুরি করিনি,ততই দোকানি তাকে শাসিয়েছে,মেরেছে তাদের পরিবারের লোকেরাও তাকে মেরেছে,এমনকি ঘটনা শুনে ছেলের মা এসে ছেলেকে মেরেছে,চোর অপবাদ দিয়েছে।এরপর ছেলেটা আত্মহত্যা করে।পরে সিসি ক্যামেরায় দেখা যায় যে সেই ছোট্ট ছেলেটাই সত্যি কথা বলেছিল,প্যাকেট রাস্তায় পড়েছিল।ছেলেটি চুরি করেনি। কিন্তু ততক্ষনে সব শেষ।
অবাক লাগে ঘটনা ঘটার পরে উন্মত্ত জনতা অভিযুক্তের বাড়িতে প্রতিবাদে আছড়ে পড়েছিল।কিন্তু,যেদিন যখন ঘটনাটা ঘটলো,সেদিন তখনই সত্যকে জানার চেষ্টা কেউই করেনি।এমনকি ছেলেটির মাও-নয়।তিনি বরঞ্চ ছেলের কথা-” মা,আমি চুরি করিনি..ওটা মাটিতে পড়েছিল,আমি কুড়িয়ে নিয়েছি–” শুনলেন না,যাচাই করে দেখলেন না,বিপরীতে তিনি ছেলেটিকে অমানুষিক ভাবে মারধোর করলেন। ছেলেটির সমস্ত আস্থা এক মুহুর্তে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। উপস্থিত মানুষজনরাও কেউ এগিয়ে যাননি সত্যাসত্য যাচাইয়ের মুল প্রশ্নে।বরঞ্চ তারা ব্যস্ত ছিলেন ফোন নিয়ে ভিডিও করতে ।সকলেই তখন মনে মনে ছেলেটিকেই দোষী সাব্যস্ত করতেই ব্যস্ত।
ভাবতে অবাক লাগে,আমরা সবাই জানি খুব ভালো করে,যে প্রতিদিন চুরি যাচ্ছে আমাদের আশেপাশের পরিবেশ,উঠছে বহুতল, চুরি যাচ্ছে জঙ্গলের অধিকার,সবুজের সমারোহ,হাজার হাজার একর কৃষিজমি,রাতারাতি গ্রাস করে নিচ্ছে শিল্পদানব,নগরায়ন। রিক্ত হয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে প্রান্তিক মানুষ, তারপর তার গায়ে তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে অমুকবাদী,তমুকবাদী।সবশেষে তাদের প্রাপ্য হয় বন্দুকের গুলি। ঝাঁঝরা হয়ে যায় সত্য,বিচারের দাবী দাওয়া,মনুষ্যত্ব, মানবিকতা,গনতান্ত্রিক অধিকার। সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে চাকরি চুরি,খাদ্য চুরি,ইমারতি সামগ্রী চুরি,মানুষের করের টাকা,গচ্ছিত টাকা ব্যাঙ্কের ঋণতহবিল পরিশোধ না করে কোটি কোটি টাকা চুরি,পরে সরকারিভাবে তাদের সেই চুরিতে সীলমোহর লাগানো-“ঋণ মকুব”।তারা বিদেশে পলায়নে ব্যস্ত তখন।প্রশাসন ঠুটোঁ জগন্নাথ হয়ে বসে থাকে। আর খেলা চলে এই তাদের ধরা হোল বোলে!!!ধরছি ধরছি করছি, তবু ধরতে পারছি না।
গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বাড়ি থেকে রাশি রাশি টাকা উদ্ধার,চিটফান্ড-এর অতল গহ্বরে লক্ষ কোটি মানুষের টাকা প্রতারণার জালে ফাঁসিয়ে, চিটফান্ডের মালিক পলাতক,প্রশাসনের সেখানেও সেই একই খেলা,চলছে বিচার,চলছে,কিন্তু সেই প্রতারিত মানুষগুলো যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল। বিদেশি ব্যাঙ্কে এত কালো টাকা আছে যে সকল ভারতীয় নাগরিকের একাউন্টে লক্ষলক্ষ টাকা দিয়েও তা শেষ করা যাবেনা-র মতো এক আকাশকুসুম প্রতিশ্রুতি কবে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে,আমরা সবাই জানি। সেখানে আমাদের প্রতিবাদ নেই,আমরা সেখানে “জো-হুজুর” বলে সেলাম ঠুকি। আর সামান্য কেউ যদি পেটের জ্বালায়,অসহায় হয়ে একটু এদিক ওদিক কিছু করে ফেলে,অবস্থার বিপাকে,তখন আমরা উন্মত্ত হয়ে পড়ি,গণধোলাই দিই। তাকে অকথ্য গালাগাল দিই,মারধোর করি।
কি বিচিত্র অবস্থা।
জানি চুরি করা অন্যায়।কিন্তু এই একটা বাক্যেই সরলিকরণ করাটাই ভুল,ধান্দাবাজী। দেখতে হবে তার প্রেক্ষিতটা কী?
আমেরিকায় একটি কিশোর বেশ কয়েকদিন অভুক্ত থেকে সাহায্য চেয়ে পায়নি পয়সা।গাড়ি ধুয়ে দিয়ে পয়সা রোজগারের চেষ্টা করেছিল পায়নি। সেই ছেলেটা একদিন একটি দোকানের সামনে একটা পাউরুটি মাটিতে পড়ে আছে দেখে পেটের জ্বালায় সেটা কুড়িয়ে নেয়। অমনি দোকানি এসে তাকে চোর অপবাদ দিয়ে পুলিশে দেয়,এবং তারপর তার বিচারের জন্যে তাকে সেদিনই স্থানীয় কোর্ট-এ পেশ করা হয়। বিচারক সব বৃত্তান্ত শুনে,শেষে উপস্থিত সকলকে,এমনকি নিজেকেও দোষী সাব্যস্ত করে জরিমানা করেন,আর যারা ঐ অভুক্ত নিরপরাধী ছেলেটিকে মেরেছিল,গালাগাল দিয়েছিল,তাদের ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেন।কারণ তিনি বলেন,সত্যাসত্য না জেনে,ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত না জেনে এই কাজ করেছেন তারাই সমাজের গনশত্রু।তাদের দন্ড দেওয়া উচিত। এমনকি বিচারক নিজেও এর জন্য দায়ী।
এখান থেকেই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। রবীন্দ্রনাথের কথায়–” যে বিচারে মানবিক আবেদন নেই,সেই বিচার কখনোই বিচার হতে পারেনা।”
আমরা এক অদ্ভুত সমাজে বাস করছি।সেই সমাজের মুখে কষিয়ে থাপ্পড় মেরে চলে গেল বিনা অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া চোদ্দ বছরের ছেলেটা–” মা,আমি চুরি করিনি–” এই শেষ কথা লিখে।
আর বলে গেল,এখন যারা অন্ধ,তারা বেশি দেখে চোখে,
যারা চোর তাদের সামনে বশংবদ হয়ে মানুষ সেলাম ঠোকে।
গরীব মানুষ এর জন্যে চোরের অপবাদ জোটে,মরে, আর, মার খায়,
আর মন্ত্রী সান্ত্রী গন্যিমান্যিরা সব পুকুরচুরি করে, আইনের ফাঁক দিয়ে,বিদেশে পালায়।
অতএব সমাজ তুমি সচেতন হও।পরিপ্রেক্ষিতকে চিনতে শেখো।