পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
“ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে”…
রবীন্দ্রনাথ এই প্রেমের আকাঙ্ক্ষার সাথে সাথে তিনিই বিষ্ময়ে জিজ্ঞাসা করেন–” সখী ভালোবাসা কারে কয়..”?
এ যেন এক প্রেমিকের মনের দ্বান্দ্বিক অবস্থা। ভালোবাসা একটি ছোট্ট শব্দ হলেও এই পৃথিবীর ইতিহাসের পাতায় পাতায় রয়েছে সেই ভালোবাসার অমৃত পরশখানি।যেন এই বিশ্বজুড়ে ভালোবাসার এক সীমা পরিসীমাহীন নকশীকাঁথা রয়েছে পাতা।রবি ঠাকুরের কথায় ভালোবাসার ফাঁদ পাতা রয়েছে এই ভুবনে, “বিশ্ব জোড়া ফাঁদ পেতেছো কেমনে দিই ফাঁকি,/আধেক ধরা পড়েছি গো আধেক আছে বাকি…”।
ভালোবাসার সংজ্ঞা বিশাল,বিরাট এবং অনন্ত অসীম।তার পরিধির ব্যাপ্তি বিস্তৃত। ইতিহাসের পাতায় বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন যুগে,সমাজের বিভিন্ন উপাখ্যান রয়েছে–যেমন,শ্রীকৃষ্ণ রাধিকার প্রেম,শ্রীকৃষ্ণ মীরাবাঈ,শ্রীকৃষ্ণ সুদামা,শ্রীকৃষ্ণ যশোদা,রামী চন্ডীদাস,জয়দেব পদ্মাবতী, বিল্বমঙ্গল,সেলিম আনারকলি,লায়লা মজনু,শিরি ফারহাদ,রোমিও জুলিয়েট, হীর রাঞ্জহা,প্রমুখ,প্রমুখের কথা ও কাহিনী।
এই প্রসঙ্গেই প্রামান্য স্বরূপ বলা যায়. যে এই বিশ্বেই পাওয়া গেছে এক ঐতিহাসিক বাস্তবতার প্রমান।প্রায় ৬/৭ হাজার বছরর অতীতের এক অনন্যসাধারণ চিত্র, যা ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, সেই ভালোবাসাই প্রমাণ করে দিয়েছে যে ভালোবাসার চেয়ে বড়ো কিছুই নেই। মরণ হয় এই শরীরের,ভালোবাসার কখনোই কোনও মৃত্যু নেই।
প্রায় ৬/৭ হাজার বছর ধরে মাটির নীচে একসাথে যুগলে ঘুমিয়েছিলেন তারা,ঘুমিয়ে রয়েছেন সেই প্রেমিক প্রেমিকা যুগলে,দু’জনে। পরম নিশ্চিন্তে, অনায়াসে কাটিয়ে দিয়েছেন তারা এতোগুলো বছর একে অন্যকে ভালোবেসে,তার কারণ, ভালোবাসার মানুষটি তার ভালোবাসার মানুষটিকে দু’হাতে আলিঙ্গন করে জড়িয়ে ধরে আছে প্রতি মুহূর্তে। তবে আর কিসের চিন্তা?কিসের ভয়? কিসের দ্বিধাবোধ?
তবে হ্যাঁ –এরা দু’জনেই কিন্তু এখন আর জীবিত নন।তাদের বহিরঙ্গের রক্ত মাংস সবই কালের অমোঘ নিয়মে মিশে গেছে মাটিতে। শুধু পড়ে আছে তাদের জরাজীর্ণ নরকঙ্কাল-এর হাড়গুলো, অস্থি। আজ সারা বিশ্বের কাছে তারা পরিচিত–“LOVERS OF VALDARO”( লাভার্স অফ ভালদারো) নামে।
২০০৬/৭ সালে একদল প্রত্নতাত্ত্বিক উত্তর ইটালির সানজর্জিও-র মান্তুয়া শহরের ভালদারো গ্রামে খননকার্য করতে গিয়ে মাটির নীচে থেকে দু’টি নরকঙ্কাল উদ্ধার করেন। সমস্ত কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর সেই প্রত্নতাত্ত্বিকেরা জানিয়েছেন যে,ওই নরকঙ্কাল দুটি বহু বহু প্রাচীনকালের। ৫ হাজার থেকে ৪ হাজার খ্রীষ্টপূর্ব সময়কালের।তার মানে অঙ্কের হিসাবে ৬/৭হাজার বছরের প্রাচীন। সেই নরকঙ্কাল দুটি পরস্পর পরস্পরকে দুহাত গিয়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে ধরে রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা জানিয়েছেন যে হয়তো তাদের দুজনকে এইভাবেই কবর দেওয়া হয়েছিল,বা তারা এই আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থাতেই মাটির নীচে চাপা পড়ে গিয়েছিলেন।
এরপর গবেষণা করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে,কঙ্কাল দুটি একজন নারীর এবং একজন পুরুষের। মৃত্যুর সময়ে এই প্রেমিকযুগলের বয়স ছিল আনুমানিক ভাবে নারীটির ২০/২২ বছর,আর পুরুষটির ৩৮/৪০ বছর। উচ্চতা ছিল ৫ ফুট থেকে ৫ ফুট ২/৩ ইঞ্চি। আলিঙ্গনাবদ্ধ এই দুজনকে মৃত্যুর পরেও কেউ আলাদা করতে পারেনি। কঙ্কালদুটির পাশে সেই যুগের একটি ছুরির মতো অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল।তাতে অনুমান করা হয় যে এই প্রেমিকযুগলকে হয়তো হত্যা করা হয়েছিল। যদিও তাদের হত্যা করার কোনও প্রামান্য লক্ষ্মণ গবেষকরা পান নি। অবশ্য এতোগুলো বছর পরে কোনও লক্ষ্মণ খুঁজে পাওয়াও প্রায় অসম্ভব।
যাইহোক, সেই প্রেমিকযুগলের সেই আলিঙ্গনাবদ্ধ কঙ্কাল দুটি সম্পুর্ণ অক্ষত রেখেই সংরক্ষিত করা আছে ইটালির সেই মান্তুয়া শহরের ন্যাশনাল আর্কিওলজিক্যাল ইনস্টিটিউট এন্ড মিউজিয়ামে। সেটি প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হয় ২০১১ সালে।
হয়তো এই প্রেমিক প্রেমিকা যুগলে তাদের ভালোবাসার শুরুতে একে অপরে পরস্পরের হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছিল–যত বাধা বিপত্তিই আসুক না কেন,কখনও এক মুহুর্তের জন্যেও তারা পরস্পরের হাত ছেড়ে যাবনা কোথাও। তাই হয়তোবা মৃত্যু নামক বাধাও তাদের কখনও কোনওদিন আলাদা করতে পারেনি।
জন্মজন্মান্তর ধরে তারা একে অপরকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসায়। এই প্রেমিকযুগলের সাথে আজ থেকে ৬/৭ হাজার বছর আগে কি ঘটেছিল, কেন তারা একে অপরকে আঁকড়ে ধরেছিল,শেষমুহুর্তে তা হয়তো কোনওদিন জানাও যাবেনা।কিন্তু তাদের এই আঁকড়ে ধরে থাকা দুজন দুজনকে –এই দৃশ্যই সারা বিশ্বকে বারংবার জানিয়ে দিচ্ছে যে ভালোবাসার কোনও মৃত্যু নেই,মৃত্যু হয়না ভালোবাসার কখনও কোনওদিন।
হয়তো তারা বলে গেল,যে কোন প্রেমিক প্রেমিকা যদি পরস্পর পরস্পরকে সত্যিই ভালোবেসে থাকে তাহলে কখনও ভালোবাসার মানুষটির সাথে অন্য কারোর তুলনা করা যায় না।করলে সেই ভালোবাসা কৃত্রিমতার সাময়িক উত্তেজনায় ভরা এক অভিনয়। তারা হয়তো এই কথাও বলে গেলেন, যে শুধু আপনার মনের মাধুরী মিশায়ে, ভালোবাসা দিয়ে ভালোবেসে যাওয়াই হোল প্রকৃত প্রেম।আমাদের দেশের নল-দময়ন্তীর মতো, কচ-দেবযানীর মতো,সোনাই-মাধবের মতো। মরণের পরেও আলিঙ্গনাবদ্ধ এই প্রেমিকযুগল হয়তো এই কথাই সারা বিশ্বকে বলে গেলেন,কালের কপোলতলে ভেসে যায়,ভেসে যাবে জীবন যৌবন ধনমান,চলে যায়,চলে যাবো,সকলেই, আমি তুমি, শুধু চিরন্তন শাশ্বত হয়ে রয়ে যাবে অকৃত্রিম প্রেমের জন্মজন্মান্তরের আমার ভালোবাসার জন্মভূমি।
আজ থেকে ৬/৭ হাজার আগে হয়তো “তবু মনে রেখো”.. আমি ভালোবেসেছিলেম তোমায়,” সবশেষে এই শেষ কথা বলে,
অন্তিমসময়ে আলিঙ্গনে ভালোবাসা নিয়েছিল বিদায়,চিরতরে গিয়েছিল চলে…।
হয়ে গেছে,হয়ে গেল কত কত বছর পার,বছরের পর বছর হাজার হাজার। ফিরে কি এসেছে ভালোবাসা? ফিরে তো আসেনি আর।
তবু রেখে যায় আলিঙ্গনের আলিম্পনে স্মৃতি শুধু স্মৃতি ভালোবাসার। পৃথিবীর প্রেম,পৃথিবীর ভালোবাসা তুলনার দাঁড়িপাল্লায় যেন পরিমাপ করা না হয়। তবেই সেখানে ভালোবাসা চির শাশ্বত সত্য অক্ষয়,অব্যয়,তবেই তো সত্যিই হবে ভালোবসার জয়।