অগ্নিযুগের সাগ্নিক, তোমাকে প্রণাম : পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

ফুলশয্যার রাতে নির্জন কক্ষে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী পুষ্প দেবীকে অতি বিনম্রতায় সদ্য বিবাহিত স্বামী বললেন, ‘‘শোন, তোমার কাছে আমার অপরাধের শেষ নেই।তুমি আমার অগ্নি সাক্ষী করা বিবাহিত স্ত্রী,তোমাকে সব সত্যি কথা বলা আমার কর্তব্য। আমার পায়ে পায়ে ঘোরে মৃত্যু। কখন কোথায় থাকি,কোথায় নেই। তুমি তো জানো,আমাদের দেশ পরাধীন। সেই দেশের মুক্তির জন্যে আমি কাজ করি। আমাদের ডাক এলেই সব কিছু ফেলে রেখে চলে যেতে হয় দেশের কাজের ডাকে। আজ এইমাত্র সেই ডাক এসেছে,—এখনই আমি চলে যাব। তবে তুমি আমার জীবনের ভালোবাসা,আমার স্ত্রী হিসাবে আমার জীবনের শেষদিন অবধি তাই থাকবে। আজ আমাকে বিদায় দাও’’।

দু’চোখে আকুল করা কান্না নিয়ে সেদিন সদ্য বিয়ে করা স্বামীকে বিদায় জানিয়ে ছিলেন কিশোরী নববধু পুষ্প দেবী। শুধু বলেছিলেন তিনি স্বামীর চিঠি পারবেন কি না। কথা দিয়েছিলেন পুষ্প দেবীর স্বামী। কথা রেখেও ছিলেন। মাঝে মধ্যে চিঠি আসতো অত্যন্ত গোপনে। সেই চিঠির শুরুতে লেখা থাকতো—‘আমার স্নেহের পুষ্প’, আর শেষে লেখা থাকতো –‘ইতি,তোমারই সূর্য’।
হ্যাঁ, ইনিই হলেন বাংলা তথা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিযুগের অগ্নিপুত্র। আর উপরে উল্লেখিত ঘটনা মা শৈলবালা দেবী এবং বাবা রমনীরঞ্জন সেনের পুত্র সূর্যরঞ্জন সেন তথা মাস্টারদা সূর্য সেন-এর বিবাহের ফুলশয্যার রাতের কাহিনি।

প্রিয়তমা পত্নী পুষ্প দেবীর সাথে আর কি কখনো দেখা হয়েছিল মাস্টারদা সূর্য সেনের?
হ্যাঁ, হয়েছিল। স্ত্রী পুষ্প দেবী তখন মারাত্মকভাবে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত, প্রায় মৃত্যু শয্যায়। সূর্য সেন তখন জেলে। কয়েক ঘণ্টার জন্য প্যারোলে ছাড়া পেয়ে ছুটে এসেছিলেন প্রিয়তমাকে দেখতে,কিন্তু না দেখা হয়নি,তার আগেই পুষ্প দেবীর জীবন দীপ নিভে গিয়েছিল চিরদিনের জন্য।

২ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৩ সাল। যে গোপন আস্তানায় বিপ্লবী সূর্য সেন ছিলেন–সেখানকারই এক আত্নীয় প্রতিবেশী। সূর্য সেনকে ধরিয়ে দিলেন দশ হাজার টাকা সরকারি পুরস্কারের লোভে পুলিশের কাছে খবর দিয়ে। তার নাম নেত্র সেন। যদিও নেত্র সেনের পরিবারের সদস্যরা এবং নেত্র সেনের স্ত্রী সকলেই সূর্য সেনকে ভগবানের মতো শ্রদ্ধা করতেন। তারা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি যে তাদেরই মধ্যে রয়েছে বিশ্বাসঘাতক। সকলেই নেত্র সেনের এই জঘন্যতম কাজের জন্য তাকে তিরস্কার করে ঘৃণা করতে শুরু করেন। আর ঠিক তিন দিন পরে,নেত্র সেনের এক ভাই কিরণ সেন নেত্র সেনকে তার স্ত্রীর সামনেই গুলি করে হত্যা করে এবং বৌদিকে প্রণাম করে ফেরার হয়ে যায়। পরে পুলিশ নেত্র সেনের স্ত্রীকে বহুবার জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনও কিনারা করতে পারেনি।
বিচারের নামে প্রহসন করে বৃটিশ সরকার ১২ ই জানুয়ারি, ১৯৩৪ সালে,চট্টগ্রাম জেলে অতি গোপনে মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসী দেয়। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে মাস্টারদার এই ফাঁসীর খবর। উত্তাল হয়ে ওঠে সারাদেশ। স্বাধীনতার আগুন জ্বলে ওঠে দিকে দিকে। সে এক অনন্য ইতিহাস।

আজ ২০২২ জানুয়ারিতে তাই বলতে হয়, তোমাকে ভুলে গেলে সেটা হবে নিজেদের পরিচয়কে ভুলে যাওয়া। তোমার বিপ্লব আজও উদীয়মান সূর্য-এর আলোর মতো চির ভাস্বর। যতদিন এই পৃথিবীতে সূর্য উঠবে, ততদিন তুমিও থাকবে, হে অগ্নিযুগের সাগ্নিক মাস্টারদা সূর্য সেন, সমগ্র স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীর অন্তরের অন্তঃস্থলে চির অগ্নীশ্বর হোয়ে। তোমাকে বিনম্রতায় শত-কোটি নমস্কার।

Related posts

পুজোয় নিম্নচাপের ভ্রুকুটি, কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে দু’দিন বৃষ্টির পূর্বাভাস

ফাইনালের আগে সুপার ওভার থ্রিলারে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে রিয়েলিটি চেক পেল ভারত, চিন্তা বোলিং নিয়ে

পুজোর ভিড় সামলাতে শিয়ালদহে বিশেষ ব্যবস্থা, চালু হচ্ছে ৩১টি স্পেশাল ট্রেন