প্রথম পাতা প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথের গানে নিবেদিতা শিল্পী সুচিত্রা মিত্র…জন্মশতবর্ষে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি

রবীন্দ্রনাথের গানে নিবেদিতা শিল্পী সুচিত্রা মিত্র…জন্মশতবর্ষে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি

915 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

বেড়াতে গিয়েছিলেন সপরিবারে পুলিশ কোর্ট-এর আইনজীবী এবং সাহিত্যিক সৌরিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়। গিয়েছিলেন ডেহরি-আন-সান-এর দিকে। ফেরার পথে বাধ্য হয়েই নামতে হয়েছিল তাঁকে পরিবার নিয়ে, তার কারণ স্ত্রী সুবর্ণলতা ছিলেন সন্তান সম্ভবা। যেখানে নেমেছিলেন, সেই স্টেশনের নাম ছিল “গুজান্টি”। দিনটি ছিল ১৯২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। সেখানেই জন্মগ্রহণ করে একটি শিশু। স্টেশনের নামের সঙ্গে মিল রেখে বাবা আর মা শিশুটির ডাক নাম রাখেন ” গজু”। আর ভালো নাম সুচিত্রা।

বেথুন স্কুল, স্কটিশ চার্চ কলেজ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা করেন সুচিত্রা।

তার আগে ১৯৪১ সালের ২৭ আগস্ট সুচিত্রা চলে যান রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে। পরিবারের সকলের ইচ্ছে ছিল সুচিত্রা গান শিখুক,তার কারন,সুচিত্রার গানের গলা ছিল অনবদ্য। সুচিত্রার খুব ইচ্ছে ছিল কবিগুরুর সান্নিধ্যে তিনি গান শিখবেন।কিন্তু,দুর্ভাগ্য,সুচিত্রার শান্তিনিকেতনে যাওয়ার ২০ দিন আগে ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট (১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরবিদায় নিয়েছিলেন।

সুচিত্রা তাঁর সঙ্গীত শিক্ষার গুরু হিসাবে প্র‍্যেছিলেন শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজা রঞ্জন মজুমদার,ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী,অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখদের।

৫ বছর ছিলেন তিনি শান্তিনিকেতনে। ১৯৪৫ সালেই সুচিত্রার গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়।গান গুলি হল, “হৃদয়ের একুল ওকুল দ’কুল ভেসে যায়,হায় সজনী..” এবং “মরণ রে তুহুঁ মম সগ্যাম সমান..”। মানুষ মুগ্ধ হয়ে গেল সুচিত্রার গানে।তারপর একের পর এক অসংখ্য রবীন্দ্র গান উপহার দিয়ে গেছেন আমাদের। যা আজও আমাদের মনের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বেজে চলে।

সুচিত্রা মিত্র রবীন্দ্রনাথের আদর্শ, দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন।মানুষের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময়ে প্রতিবাদ করে গেছেন। তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের (IPTA) সাথে ওতোপ্রোতোভাবে যুক্ত ছিলেন।তিনি সহসাথী হিসাবে পেয়েছিলেন ভারত বিখ্যাত শিল্পীদের। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন,দেবব্রত বিশ্বাস,হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,শম্ভু মিত্র,তৃপ্তি মিত্র,বিজন ভট্টাচার্য, মহাশ্বেতা দেবী,কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়,ঋত্বিক ঘটক,মৃণাল সেন,বলরাজ সাহনি,ভীষ্ম সাহনি,এ.কে.হাঙ্গল,দীনা পাঠক,কায়ফি আজমি(শাবানা আজমির বাবা),প্রেমচাঁদ,সলিল চৌধুরী,রাজ কাপুর, প্রমুখদের।

সুচিত্রা মিত্র সারাজীবন রবীন্দ্রনাথের গান এবং রবীন্দ্রনাথের আদর্শকেই একমাত্র অবলম্বন করে বেঁচেছিলেন।

সুচিত্রা মিত্র বহু রাষ্ট্রীয় সম্মানে,প্রাতিষ্ঠানিক সম্মানে,বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানে সমাদৃতা হয়েছিলেন।তিনি কলকাতার শেরিফও হয়েছিলেন। তাঁর লেখা আত্মজীবনী গ্রন্থের নাম “মনে রেখো”…। বাংলা ও বাঙালির কাছে সুচিত্রা মিত্র এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব, যাঁকে বাঙালি ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার অনুভুতি নিয়ে সম্মান করবে চিরকাল।

২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি সুচিত্রা মিত্র জীবনের সবকিছু মায়া ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য অমৃতময়-রবীন্দ্রলোকে চলে গেছেন।রেখে গেছেন তার কীর্তির সম্ভার,যা আপামর বাঙালির এক ঐতিহাসিক সম্পদ। এক ইতিহাস।

সুচিত্রা মিত্রের জন্মশতবর্ষ আমাদের কাছে এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের দলিল। এই শতবর্ষ-এ রেখে যাই রবীন্দ্রনাথের গানে নিবেদিতা কিংবদন্তি শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের পদপ্রান্তে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা এবং প্রণাম।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.