“একাত্তরের জননী”, তোমায় প্রণাম…

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

১৯৪১ সালের ১৪ই অক্টোবর অবিভক্ত বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বোয়ালখালি থানার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন “একাত্তরের জননী” নামে খ্যাত রমা চৌধুরী।

তিনিই চট্টগ্রামের প্রথম মহিলা,যিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন। পরের বছর,১৯৬২ সালে রমা দেবী চট্টগ্রামের কক্সবাজার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে শিক্ষক জীবন শুরু করেন।

এরমধ্যে রমা দেবীর বিয়ে হয়। তিন সন্তান আর বৃদ্ধা মাকে নিয়ে তাঁর পাপোদিয়ার বাপের বাড়িতেই সংসার।কারন কাজের জন্য রমা দেবীর স্বামী তখন ভারতে চলে আসেন।রমা তাঁর স্কুলের চাকরি আর সংসার নিয়ে পূর্ব বাংলায় থেকে যান।

এরপরের ইতিহাস এক ভয়ংকর ইতিহাস।এলো সেই ভয়াবহ ১৯৭১ সালের পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর এবং রাজাকারদের অত্যাচারের দিনগুলি।চারিদিকে খুন, ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া,মহিলাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার, সম্ভ্রম হানী করা…ইত্যাদি ইত্যাদি।

১৩ ই মে,১৯৭১ সালের দুপুরে পাকিস্তানের হানাদার আর পূর্ব বাংলার পাকিস্তানের বশংবদ রাজাকার বাহিনী একসাথে আক্রমণ করেছিল রমা চৌধুরীদের বাড়ি। তিন সন্তানের গলার কাছে বেয়নেট ধরে রমা দেবীকে পরপর বেইজ্জত করা হয়।একসময়ে রমা দেবী পালিয়ে গিয়ে পাশের পুকুরে জল এবং জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে পড়েন। তারপর, হানাদাররা গান পাউডার দিয়ে রমা চৌধুরীদের বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। সে এক নৃশংস মর্মান্তিক কাহিনির ইতিহাস।

দীর্ঘ একটি বছর রমা দেবী তিন শিশু সন্তানকে আর বৃদ্ধা মা-কে নিয়ে দিনেরবেলায় গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতেন।আর রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি সেই আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়িতে এসে থাকতেন।আবার ভোরের আলো ফোটবার আগেই চলে যেতেন জঙ্গলে। এইসব দিনের কথা তিনি লিখে গেছেন তাঁর লেখা “একাত্তরের জননী”.. নামক গ্রন্থে।

রমা দেবীর জীবন ছিল অনেক কষ্টের।তিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারীর মধ্যে তাঁর তিন সন্তানকেই হারান অকালে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি লেখালেখিকেই জীবন জীবিকা হিসাবে গ্রহন করেন। একটি পাক্ষিক পত্রিকাতে তিনি লিখতেন। কিন্তু সেখানে কোনো পারিশ্রমিক পেতেন না।পেতেন ৫০টি পত্রিকা,যা তিনি ফেরী করে বিক্রি করতেন,আর সেই পয়সাতেই তিনি একবেলা খেয়ে দিন কাটিয়ে দিতেন। বাকি পয়সা তিনি গরীব, নির্যাতিতদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। এইভাবেই তিনি পরে ১৮ টি গ্রন্থ প্রকাশ করেন,এবং, তিনি সেই বইগুলি রাস্তায় রাস্তায় ফেরী করে বিক্রি করতেন। রমা চৌধুরীর গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে… “একাত্তরের জননী..”, “১০০১ দিন যাপনের পদ্য”, ” আগুন রাঙা আগুন ঝরা অশ্রু ভেজা একটি দিন”, ” ভাবে বৈচিত্রে রবীন্দ্রনাথ.. “, ” অপ্রিয় বচন..” ইত্যাদি ইত্যাদি।

এখনে উল্লেখ্য যে, রমা দেবী ১৯৭১ এর ১৩ ই মে-র পর থেকে পায়ে জুতো পরেন নি।একবেলা খেতেন,বাকি টাকা তিনি গরীব মানুষদের জন্য খরচ করতেন।রমা দেবীকে চট্টগ্রামের রাজসাহীর মানুষ “একাত্তরের জননী ” বলে ডাকতেন,শ্রদ্ধা করতেন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার রমা চৌধুরীকে বিভিন্ন সম্মানে সমাদৃত করেন।

এই “একাত্তরের জননী” তাঁর বাড়ি, টাকা পয়সা,সহ সবকিছু জনগনের জন্য দান করে গেছেন। তাঁর বাড়িতে এখন একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে।

২০১৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর ভোর ৪টে ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তিনি চলে গেলেন চিরশান্তির দেশে।রেখে গেলেন তাঁর জীবনের অতি সকরুণ কাহিনীর ইতিহাস।

একাত্তরের জননী রমা চৌধুরীকে জানাই প্রণাম। যেখানেই থাকুন,খুব ভালো থাকুন আমাদের বাঙলা ও বাঙালির একাত্তরের জননী… রমা চৌধুরী। তোমাকে বাঙালী এবং বাঙলা মনে রাখবে চিরদিন, চিরকাল।

একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী, তুমি ভালো থেকো মা আমার।

Related posts

আমাদের দেশ, আমাদের দ্বেষ-বিদ্বেষ এবং রবীন্দ্রনাথ

কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর, সে-দেহে তাহার কোন প্রমাণ ছিল না

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…