হিন্দু নয়, মুসলিম নয়, মাতৃভাষার জন্য বাঙালির আত্মবলিদান…পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল…

কলকাতার রাজপথে মাতৃভাষা দিবসের প্রস্তুতি। ছবি: রাজীব বসু

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর রাষ্ট্রসংঘ এবং ইউনেস্কো ২০০টি দেশের উপস্থিতিতে ঘোষণা করেছিল, যে, মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষার জন্যে বাঙালির ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ঐতিহাসিক প্রতিবাদের এবং আত্মবলিদানের যে ইতিহাস বাঙালি সারাবিশ্বে রচনা করেছে, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী দিনটি সারা পৃথিবীতে “মাতৃভাষা দিবস” হিসাবে উদযাপিত হবে,এবং এই কর্মসূচী প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে বিশ্বের সকল দেশে পালিত হবে।সেদিন উপস্থিত সকল দেশের প্রতিনিধিরা একবাক্যে এই ঘোষনাকে সম্মান জানিয়ে সম্মতি জানিয়েছিলেন।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীর ইতিহাস সারাবিশ্বের প্রায় ৫০ কোটি বাঙালী কমবেশী সকলেই জানেন। না সেই ইতিহাসে নেই কোনও হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ মানসিকতা,নেই কোনও জাত-ধর্ম,জাত-পাতের ভেদাভেদ। এর ইতিহাস হলো হিন্দু রাখোহরির মায়ের ভাষা,মুসলিম আল্লারাখার আম্মির ভাষা,মুসলিম সালমা-র আম্মির ভাষা,হিন্দু সরমা-র মায়ের ভাষার–এককথায় আমাদের বাংলাভাষার সম্মান রক্ষার ইতিহাস। ধর্ম সেখানে নেহাতই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই ইতিহাস মায়ের জন্য,আম্মির জন্য জন্মভূমির জন্য,মাতৃভূমির জন্য রক্তাক্ত,তরতাজা জীবনকে উৎসর্গ করার ইতিহাস। সেই ইতিহাসকে প্রতিটি বাঙালী জানায় প্রণাম,জানায় সালাম। সেই ইতিহাসে লেখা হয়েছিল সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউর-সহ ১৩ জনের তরতাজা বুকের রক্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (এখন বাংলাদেশ) প্রাঙ্গণে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী (৮ই ফাল্গুন, ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) বৃহস্পতিবার দুপুরের চিরন্তন শাশ্বত সূর্যকে সাক্ষী রেখে বাঙালির আত্মবলিদানের কাহিনী।

সেই ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক সেদিন জোর করে পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ব বাংলা//এখনকার বাংলাদেশ) বাঙালা ভাষাভাষী মানুষদের ওপরে সরকারী ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষাকে চরম অপমান করে চাপিয়ে দিয়েছিল উর্দু ভাষাকে।সেদিন কোনও হিন্দু নয়,কোনও মুসলমান নয়,সেদিন গর্জে উঠেছিল আপামর বাঙালী। তারই প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ,আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে (এখন বাংলাদেশ) শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী জমায়েতে, মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিলো শাসকের পুলিশবাহিনী। শহীদ হয়েছিল বাঙালির ঘরের সন্তান।

ঠিক একইভাবে স্বাধীন ভারতবর্ষে, আসামের বরাকর উপত্যকায় শিলচরের রেলষ্টশনে ১৯৬১ সালের ১৯ শে এপ্রিল সেখানকার বাঙালিদের ওপরে জোর করে হিন্দীভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে প্রতিবাদী মিছিলের ওপরে সরকারী নির্দেশে শাসকের পুলিশবাহিনী গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিল ১১ জন বাঙালীকে। সেদিন রক্তে ভিজে গিয়েছিল মাটি,রেললাইন রেলষ্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। সেদিন মাতৃভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন এপার বাংলা ওপার বাংলার–কানাইলাল নিয়োগী,চন্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস,সত্যেন্দ্র চন্দ্র দেব,কুমুদরঞ্জন দাস,সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ,শচীন্দ্র পাল,বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ, কমলা ভট্টাচার্য।

মাতৃভাষার জন্য আত্মবলিদানের ইতিহাস এখানেই শেষ নয়। মায়ের ভাষার সম্মান রাখতে ১৯৭২ সালের ১৭ই আগষ্ট শহীদ হয়েছিলেন করিমগঞ্জের বিজন চক্রবর্তী।

এরপর, ১৯৮৬ সালের ২১ শে জুলাই, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বাংলা ভাষার দাবীতে আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ হ’ন করিমগঞ্জের জগন্নাথ দেব,দিব্যেন্দু দাস,মকবুল হোসেন।

সারা ভারতবর্ষে তো বটেই,এই এশিয়া মহাদেশে তথা সারা পৃথিবীতে মাতৃভাষার জন্য এমন ঐতিহাসিক ঘটনা হয়তো আছে,কিন্তু, সারাবিশ্বে এমন ইতিহাস তৈরী করানো, সাড়াজাগানো মাতৃভাষার জন্য আত্মবলিদানের ইতিহাস বোধহয় দ্বিতীয়টি আর নেই।

যেখানে হিন্দু-মুসলমান-এর সাম্প্রদায়িকতা নেই, উঁচু নীচু জাত-বেজাত নেই, রয়েছে শুধু মানুষ, রয়েছে শুধু মায়ের জন্য, আম্মিজানের জন্য; বাপের জন্য,বাপজানের জন্য বুকের রক্ত নিঃশঙ্কোচে ঢেলে দেওয়ার মতো বাংলামায়ের সন্তান–যার নাম বাঙালী।

এই সকল বীর শহীদদের প্রতি, সারা বিশ্বের মায়ের জন্য বলিদান দেওয়া জানা অজানা শহীদদের প্রতি আজ এই ২১ শে ফেব্রুয়ারী,বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসে রেখে যাই বিনম্র শ্রদ্ধায় অসংখ্য প্রণাম আর সালাম।

ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদ দিবস
২১ শে ফেব্রুয়ারী, ১৯শে এপ্রিল, ১৭ ই আগস্ট, ২১শে জুলাই…
ভুলি নাই, বন্ধু ভুলি নাই…
রইল লক্ষ প্রণাম,রইল লক্ষ সালাম,বিনম্রতায় চরণ ছুঁয়ে যাই…।

Related posts

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

চৈত্র বৈশাখ মধুমাধবের মায়ায় মায়ায়