আধুনিক বিশ্বে আজও নারী উপেক্ষিতা…তাই নারী শপথ নিক আপন কীর্তিতে

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

আজকের ইয়াং জেনারেশানকে,এমনকি তাদের অভিভাবকদেরও যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, যে, বলুন তো বিশ্ববন্দিত কয়েকজন বিজ্ঞানীর নাম। তাহলে সাধারণত উত্তর পাওয়া যাবে, আইন্সটাইন, নিউটন, এডিসন, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, প্রমুখদের নাম। যদি জিজ্ঞাসা করা হয় মহিলা বিজ্ঞানীর নাম। উত্তর পাওয়া যাবে…মেরী কুরী, ব্যস, আর দ্বিতীয় কোনো নাম সচরাচর উত্তরে পাওয়া যাবে না। আর যদি আমাদের দেশ ভারতবর্ষের কোনো কৃতি মহিলা বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ-এর নাম জিজ্ঞাসা করা হয়, তাহলে তো নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যে, কেউই কোনো নাম বলতে পারবেন না। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, বা করছেন, তাঁদের অধিকাংশরাই

আন্তর্জাতিক মানে cosmic ray নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানী বিভা চৌধুরীর নাম,বা,এশিয়ার প্রথম মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ইলা মজুমদারের নামই শোনেননি। শুধু তাই নয়,আমাদের ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা উদ্ভিদবিজ্ঞানী জানকী আম্মাল্-এর নাম,নিউট্রিশন সায়েন্সের আন্তর্জাতিক মানের মহিলা বিজ্ঞানী কমলা ভাগবত সোহনী-র নাম,আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত মহিলা প্রযুক্তিবিজ্ঞানী রাজেশ্বরী চট্টোপাধ্যায়-এর নাম,আন্তর্জাতিক স্তরের বিশিষ্ট মহিলা পদার্থবিজ্ঞানী পূর্ণিমা সিং-এর নাম আমরা ক’জনই বা জানি!!??

সত্যিই ভাবলে অবাক লাগে, আজও আমাদের রাজ্যে,বা দেশে কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স এবং টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করা অধিকাংশ পড়ুয়ারাই আন্তর্জাতিক স্তরের মহিলা বিজ্ঞানী ভেরা কুপার্ রবিন্-এর নাম,বিজ্ঞানী ডরোথী হজকিন্-এর নাম,
বিজ্ঞানী লিজা মাইটনার্-এর নাম,বিজ্ঞানী বারবারা ম্যাক্লিনটক্-এর নাম, বিজ্ঞানী রোজালিন্ড ফ্র‍্যাঙ্কলিন-এর নাম সহ অন্যান্য মহিলা বিজ্ঞানীদের নাম শোনেনই নি।

এই একবিংশ শতাব্দীতে আজও আমাদের দেশ ভারতবর্ষের মতো সারা পৃথিবীর অনেক দেশেই Mathematics (অঙ্ক), Science-এর বিভিন্ন শাখা, Technology (প্রযুক্তিবিজ্ঞান)-নিয়ে পড়াশোনা করা,রিসার্চ করা,ডক্টরেট, পোস্ট ডক্টরেট করার ক্ষেত্রে পুরুষদের কথাই ভাবা হয়।মেয়েরাও যে এইসব বিষয়গুলোতে পুরুষের সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লা দিয়ে নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে,সেকথা ভাবতেই পারে না।

কিন্তু, সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো এই যে বিজ্ঞানের বিভিন্নক্ষেত্রে একাধিক নোবেলবিজয়ী মহিলাও তাঁদের আত্মকাহিনীতে উল্লেখ করেছেন তাঁদের পূর্বসূরী মহিলা বিজ্ঞানীদের কথা,যাঁদের কাছ থেকে এইসব নোবেলজয়ী মহিলা বিজ্ঞানীরা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তাই,একথাও অতি অবশ্যই আমরা স্বীকার করতে বাধ্য যে,আমাদের আজকের এই আধুনিক বিশ্বে, আমাদের দেশে দূর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের সূচীতে বিজ্ঞানের বিভিন্নক্ষেত্রের এইসব আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না,বিশ্ববন্দিতা মহিলা বিজ্ঞানীদের জীবনালেখ্য এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁদের অবদানের কথা কোনও ভাবেই উল্লেখ থাকেনা। এই উপেক্ষার ইতিহাস অনেক প্রাচীন, বোধহয় মানবসভ্যতার শুরু থেকেই।আমাদের দেশের প্রাগৈতিহাসিক সময়কালের অরুন্ধতী, মৈত্রেয়ী, গার্গী,খনা,লীলাবতী(যিনি বীজগণিতের আবিষ্কারিকা),ক্ষণপ্রভা, জবালা,প্রমুখরা সেযুগের মহীয়সী বিদুষী নারী হয়েও উপেক্ষিতা ছিলেন। সারাবিশ্বে এই ইতিহাস সব দেশেই রয়েছে। এবং সেই ধারা বয়ে আসছে আজও।

তাই,আন্তর্জাতিক স্তরে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে,প্রযুক্তিতে এবং গণিত শাস্ত্রে মহিলাদের অবদান এবং কীর্তির সামগ্রিক ইতিহাস এখনকার প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে,আন্তর্জাতিক স্তরে ২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছরের অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় মঙ্গলবার পালন করা হয় “Aada lovless day” (আডা লাভলেস ডে)।

এই বছর সেই দিনটি পড়েছিল ১০ অক্টোবর, মঙ্গলবার। এখন প্রশ্ন আসতে পারে এই আডা লাভলেস কি?বা কে?

আজকের দুনিয়ার অপরিহার্য অঙ্গ কম্পিউটারের অন্যতম পথিকৃৎ বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ অগাস্টা আডা লাভলেস ছিলেন ভিক্টোরিয়ান যুগের ইতিহাসের এক বিষ্ময়কর বিরল প্রতিভার অধিকারিনী মহিলা। তার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলনা।তিনি সেইসময়কার প্রথিতযশা বিজ্ঞানী সংখ্যাতত্ত্ববিদ,গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেরী সামারভেলি-র কাছে শিক্ষালাভ করেছিলেন সমস্ত বিষয়ে। আজকের বিশ্বে কম্পিউটার আসার ১০০/১৫০ বছর আগে অগাস্টা আডা লাভলেস জটিল গণিতের বিভিন্ন বিষয়,
analitical সঙ্কেত, formula and principle, logic ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্লেষণ করে প্রথম বুঝেছিলেন যে মানবসভ্যতায় কম্পিউটারের মতো যান্ত্রিকতাবাদের প্রয়োজনীয়তার অবশ্যম্ভাবীতা। বলা যায় আজকের সফিস্টিকেটেড ডিজিটাল যুগের শুরু এবং প্রতিষ্ঠার প্রস্তরফলক স্থাপিত হয়েছিল এই মহিলা প্রযুক্তিবিদ অগাস্টা আডা লাভলেস-এর উদ্ভাবনী মস্তিষ্ক থেকেই।

এই বিশেষ দিনটি প্রতিটি নারীর শপথ নেওয়ার দিন।নিজেদের স্বাধীকার অর্জনের জন্য, নিজেদের কীর্তির স্বীকৃতির জন্য।

এই পৃথিবীর সকল নারী তার আপন প্রতিভায় প্রতিভাসিত হোক,এই শুভ কামনায় তাদের প্রতি অগ্রিম অভিনন্দন শুভেচ্ছা রেখে গেলাম।

Related posts

আমাদের দেশ, আমাদের দ্বেষ-বিদ্বেষ এবং রবীন্দ্রনাথ

কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর, সে-দেহে তাহার কোন প্রমাণ ছিল না

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…