পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
মুখোমুখি দু’জন বঙ্গসন্তান। একজন ইতিমধ্যেই বিখ্যাত-সর্বজন নমস্য,বিরাট ব্যক্তিত্বের এক প্রবীণ মানুষ, আর একজন সদ্য তারুণ্য পেরিয়ে যৌবনে পা দেওয়া কনিষ্টমাত্র।
কিছুক্ষণ ধরে কথালাপ হোল দুজনের মধ্যে। প্রসন্নমুখে প্রবীন ভদ্রলোক বললেন — “তা বেশ,বেশ,আমি সব বাধা সরিয়ে নেব।কিন্তু আমি তো ভাবছি,এতোদিন আসোনি কেন? আরও আগে তো আমার কাছে আসবে!”
যুবকটি সপ্রতিভ। সারা শরীরে তখন তার এক শিহরণ, তিনি উত্তর দিলেন–” আপনার অনুমতি পেলে আমি স্কটিশচার্চ কলেজে ভর্তি হতে পারি। স্বয়ং প্রফেসর মিস্টার আর্কুহার্ট সেখানে ফিলজফি পড়ান।আমার তাঁর কাছে পড়ার খুব ইচ্ছে।কিন্তু এদিকে…”।
আগন্তুক যুবক এসেছেন সেই সকালবেলায়,এসেছেন ভবানীপুরেতে সেই প্রবীণ ভদ্রলোক-এর বাড়ি, কাছেই এলগিন রোড থেকে।
যুবক বললেন–” আমি ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর-এর কাছে আসিনি,,আসিনি কলকাতা হাইকোর্ট-এর বিচারপতির কাছেও, আমি এসেছি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়-এর কাছে। যা করার আপনিই করতে পারবেন।”
একদৃষ্টিতে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় দেখে নিচ্ছেন যুবকটির ভেতরটা। চিনে ফেলেছেন সেই প্রথম দিনই-যেদিন তিনি শুনেছিলেন,যে বাঙালিকে,তথা ভারতীয়দের সম্বন্ধে অশালীন কথা বলায় প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রফেসর ওটেন সাহেবকে তার অশালীন ঔদ্ধত্যের মুখের ওপর জবাব দিয়ে ছিল,আর সেইজন্য কলেজের ইংরেজ কতৃপক্ষ প্রেসিডেন্সি কলেজের সেই তেজস্বী ছাত্রটিকে আর কলেজে পড়ার অনুমতি দেয়নি। এখন তাঁর সামনে সেই তেজস্বী ছাত্র সুভাষচন্দ্র বসু বসে আছে।এবার আশুতোষ বললেন – ” আমি তোমার আসার অপেক্ষাতেই তো ছিলাম। আমি জানি তুমি ব্রিলিয়ান্ট। তুমি প্রতিবাদী,তোমার জাতীয়তাবোধ স্বামী বিবেকানন্দের দ্বারা উদ্বুদ্ধ,I am proud of you,my son…। আমি সব ঠিক করে দেব, তুমি কলেজে ভর্তি হও। আর এই তেজ সারা জীবন যেন থাকে,এই আশীর্বাদ করছি।যাও পড়াশোনা করো,বড় হও।দেশকে ভালোবাসো।দেশের জন্য কাজ করো”।
প্রণাম করলেন সুভাষচন্দ্র সেই প্রবীন বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় -কে।
এই ইতিহাস আমাদের বাঙালীদের ইতিহাস। আজ থেকে ১৬১ বছর আগে ১৮৬৪ সালের ২৬শে জুন কলকাতার বৌবাজারে আশুতোষ জন্মগ্রহন করেন। বাবা ছিলেন বিখ্যাত গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আর মা ছিলেন শ্রীমতী জগত্তারিনী দেবী।
এক অতি বিস্ময়কর প্রতিভা ছিল আশুতোষ -এর। ঘরের মেঝেতে,দেওয়ালে সারাদিন ধরে অংকের নানা সমাধান করতেন। ছাত্রাবস্থায় তাঁর তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ ইংল্যান্ডের বহু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় সারা বাংলায় দ্বিতীয় এবং বি.এ.পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন। পরে তিনি আইন বিষয়ে “Doctor of Law” উপাধিতে সম্মানিত হন। মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হন।১৯০৩ সাল থেকে ১৯১৩ সাল এই সময়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হন। তিনি সমস্ত বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন- বিজ্ঞান, অঙ্ক, দর্শন, আইন, ইংরেজি, বাংলা ভাষা, প্রভৃতিতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ার ব্যবস্থা তিনিই করেন। তিনি কলকাতা হাইকোর্ট-এ প্রথমে ওকালতি,এবং পরে বিচারপতি নিযুক্ত হন।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ইংরেজ শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদ করেছেন।সে সব এক ইতিহাস। তিনি অত্যন্ত মাতৃভক্ত ছিলেন।মায়ের অনুমতি না পাওয়ায় তিনি তখনকার ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জনের বিলেত যাওয়ার আমন্ত্রনও প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিলেন।
আলিগড় থেকে হাওড়াতে ট্রেনে করে আসার সময়ে একই কামরায় যাত্রী ছিলেন স্যার আশুতোষ এবং এক উচ্চপদস্থ ইংরেজ। আশুতোষ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন,সেই সময়ে সেই ব্রিটিশ আশুতোষ-এর পায়ের জুতো জোড়া জানলা দিয়ে ফেলে দেয়।আর তারপর সেই ব্রিটিশ নিজেও একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। এদিকে আশুতোষ-এর ঘুম ভাঙার পরে নিজের জুতো না পাওয়ায়,সেই ব্রিটিশ অফিসারের খুলে রাখা গায়ের কোট জানলা দিয়ে আশুতোষ ফেলে দেন। পরে সেই ইংরেজ ঘুম থেকে উঠে কোট না পেয়ে যখন আশুতোষ-কে সেই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে,তখন আশুতোষ তাচ্ছিল্যের সাথে মুখের ওপর জবাব দেন–“your court has gone to fetch my shoes”.
তখন কলকাতার রেড রোড দিয়ে ব্রিটিশ ছাড়া আর কেউ গাড়ি নিয়ে যেতে পারতো না।নিষেধ ছিল আশুতোষ প্রতিবাদ করে ব্রিটিশকে মাথা নত করতে বাধ্য করান আর রেড রোড সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।
বাংলার এই তেজস্বী, বাংলার বাঘ দেশপ্রেমিক স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়-এর ১৯২৪ সালে,২৫ শে মে, আজ থেকে ১০০ বছর আগে কলকাতার ভবানীপুরের বাড়িতে মহাপ্রয়ান ঘটে।
এক অনন্যসাধারণ ব্যাক্তিত্বের মানুষ আমাদের প্রনম্য, বাংলার বাঘ, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর চরণ প্রান্তে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।