“সিংহস্থা শশীশেখরা মরকত প্রেক্ষা…দুর্গা দুর্গতিনাশিনী…”, মহালয়া এবং কিছু কথা

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

মহালয়া। একটি দিন।যেদিন ভোর ৪টের সময়ে “মহিষাসুরমর্দিনী” গীতিআলেখ্য-টি আকাশবাণী রেডিও থেকে সম্প্রচারিত হয়েছিল ১৯৩৪ সালে। সেই সময়ে আকাশবাণীর স্টেশন ডাইরেক্টর ছিলেন নৃপেন মজুমদার। তার আগে নৃপেন বাবু তার সহকর্মী বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য (বানীকুমার),বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র,পঙ্কজ কুমার মল্লিক,প্রমুখদের সাথে আলাপ আলোচনায় দেবী দুর্গার আরাধনার প্রাক্কালে শরতের মহালয়ার ভোরে একটি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেন।সেইমত,বানীকুমার মার্কন্ডেয় পুরাণ,দেবী পুরাণ,শ্রীশ্রী চন্ডী, ইত্যাদি আদি গ্রন্থাবলি থেকে অংশ বিশেষ নিয়ে লিখে ফেলেন “মহিষাসুরমর্দিনী”-র স্তোত্র,এবং স্তোত্রগানের কথা।তাতে সুর দেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক এবং স্তোত্রপাঠ-এর দায়িত্বে থাকেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সেই শুরু হয়েছিল পথ চলা। ধীরে ধীরে মহালয়ার ভোরের এই অনুষ্ঠান বাঙালির ঘরে ঘরে এক অবিস্মরণীয় অবিসংবাদিত অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।

সেই ভোরের শান্ত শীতল হাওয়ার আমেজে যখন বেজে ওঠে.. ” আজ আশ্বিনের শারদ প্রাতে…”, কিম্বা যখন সুরের মুরছণায় ভেসে যায় আকাশ বাতাস..”বাজলো তোমার আলোর বেণু,মাতলো রে ভুবন..” অথবা ” জাগো তুমি জাগো,জাগো দুর্গা,জাগো দশপ্রহরণধারিনী..”,তখন সেই ভোরের আধো ঘুমের,আধো জাগরণের তন্দ্রালু জড়িমায় সমস্ত বাঙালীর মনে প্রাণে এক ঐতিহাসিক অনিন্দ্যসুন্দর অনুভুতির সৃষ্টি করে,যা অতুলনীয় এক পরম্পরা। জানা যায় যে স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই অনুষ্ঠান শুনেছিলেন। এই অনুষ্ঠান শুনেছিলেন বেলুড়মঠের শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এবং শ্রীমা সারদার সান্নিধ্যে থাকা সন্ন্যাসীরা।শুনতেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু,অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এককথায় বলা যায় বিংশ শতাব্দীর প্রথিতযশা সাহিত্যিক কবি,বিজ্ঞানী,রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সহ আপামর বাঙালী।এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন সকল সম্প্রদায়ের মানুষ বিভিন্নভাবে।

আজও সেই ধারা চলে আসছে।যদিও পরিবর্তন হয়েছে অনেক।রেডিওর যুগের পরে আধুনিক সময়ে এসেছে টেলিভিশন। আজ বেশ কয়েকবছর ধরে সেই টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে মহালয়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয় বিভিন্ন আঙ্গিকে। বাঙালী সেইসব অনুষ্ঠানগুলিও দেখেন, উপভোগ করেন। কিন্তু,তা সত্ত্বেও বলা যায়,সেই ৯০/৯১ বছর আগের শুরু হওয়া “মহিষাসুরমর্দিনী” অনুষ্ঠানটি এখনো একইভাবে বাঙালির সবচেয়ে মনকাড়া অনুষ্ঠান।

এখন,এই অনুষ্ঠান সারা ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি কেন্দ্র থেকে সেই সেই প্রদেশের আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ করে প্রচারিত হয়। এমনকি বিদেশেও এই অনুষ্ঠান প্রবাসী রা শুনে থাকেন। এই তথ্য পাওয়া যায়,ইন্ডিয়ান অডিয়েন্স রিসার্চ ব্যুরোর রিপোর্ট থেকে।সেখানে বলা হয়েছে,যে,৯৮.৭৪% মানুষ এই অনুষ্ঠান শোনেন। অবশ্যই এটা একটা গৌরবের কথা।

ভাবলে অবাক লাগে,যে একটি অনুষ্ঠান আজ শতবর্ষ উদযাপনের শেষ দশকে প্রবেশ করলো এই ২০২৩ এর আজকের দিনে..যার নাম “মহিষাসুরমর্দিনী”।

পিতৃপক্ষের সমাপ্তিতে দেবীপক্ষের শুরুর প্রথমদিনে মহালয়ার ভোরের এই অনুষ্ঠান বাঙালীর সংস্কৃতির এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের কীর্তি বহন করে চলেছে সেই ৯০/৯১ বছর আগে থেকে,যা আজও অম্লান। প্রত্যাশা করাই যায় যে আগামী ২০৩৩ সালে যখন এই মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটি ঐতিহাসিকভাবে শতবর্ষ উদযাপন করবে,তখন আজকের এই প্রজন্মের কাছে তা হবে এক ঐতিহাসিক প্রাপ্তি।

শেষ করি,এই মহিষাসুরমর্দিনীর সেই উদাত্ত স্তোত্রপাঠ দিয়ে… ” যা দেবী সর্বভুতেষু সৃষ্টি রূপেন সংস্থিতা,নমস্তস্যই,নমস্তস্যই, নমস্তস্যই নম নমোহ্।”

মহালয়ার দিনের আরেকটি তাৎপর্য হল, এইদিন আমাদের পিতৃপুরুষদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধানিবেদনের দিন,পিতৃতর্পনের দিন। এদিন উচ্চারিত হয়,”পিতা ধর্ম,পিতা কর্ম,পিতহি পরমং তপঃ..”, এবং “জননী জন্মভুমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী…”।

তাই বলা যায় এই মহালয়ার দিনটি হলো এক পরম পবিত্র ঐতিহাসিক পরম্পরার ঐতিহ্যবাহী দিন।যা বাঙালী জীবনের অঙ্গ…।

Related posts

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

চৈত্র বৈশাখ মধুমাধবের মায়ায় মায়ায়