রবীন্দ্রনাথের ‘সখা’ এবং আতুর আর্ত ব্রাত্যজনের ‘দীনবন্ধু’ এন্ড্রুজ

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহের এবং ভালোবাসার “সখা”,কখনোবা কবিগুরুর আদরের ” চার্লি”– আর গুরুদেব ছিলেন সেই সখার কাছে তাঁর “গুরু”। স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন তাঁর চলার পথের পাথেয়, জীবনের মন্ত্র। ভিন্ন দেশের,ভিন্ন ভাষার-সংস্কৃতির মানুষ ছিলেন তিনি,তবু সেই ভিন্নতা কবিগুরুর এবং এই ভারতবর্ষের প্রতি তাঁর ভালোবাসার অন্তরায় কোনওদিনই হয়নি। নিজের দেশ থেকে চলে এসেছিলেন এক অন্যদেশ– ভারতবর্ষে। আপনজনেদের কাছ থেকে একে একে হারিয়ে গেছেন তিনি– ভারতবর্ষের মাটিকে,এদেশের মানুষকে, এদেশের সংস্কৃতিকে করে নিয়েছিলেন আপনাত্মীয়। কবিগুরুর শান্তিনিকেতন হয়ে উঠেছিল তাঁর শান্তির বাসভূমি, তাঁর প্রেমের মৃত্তিকা,আত্মার আত্মীয়, হৃদয়ের আশ্রয়স্থল।

মানুষকে ভালোবেসে,মানুষের পাশে থেকে,আর্ত- আতুর মানুষের দিকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের দীনশরণময় এক মহৎপ্রাণ- অসহায়ের, দীনের বন্ধু– “দীনবন্ধু”।

আসল নাম ছিল চার্লস্ ফ্রিয়ার এন্ড্রুজ ( Charles Freer Andrews),কেউ কেউ তাঁকে ডাকতেন ” Christ’s Faithful Aposite)– ভারতবর্ষে তিনি পরিচিত ছিলেন “দীনবন্ধু সি.এফ. এন্ড্রুজ” নামে।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন একটি কবিতা এন্ড্রুজকে নিয়ে–” প্রতীচীর তীর্থ হতে প্রাণরসধার,/ হে বন্ধু,এনেছো তুমি,করি নমস্কার। // প্রাচী দিল কন্ঠে বরমাল্য তার/ হে বন্ধু, গ্রহন করো,করি নমস্কার।// খুলেছ তোমার প্রেমে আমাদের রুদ্ধ দ্বার,/ হে বন্ধু,প্রবেশ করো, করি নমস্কার। // তোমারে পেয়েছি মোরা দানরূপে যাঁর,/ হে বন্ধু চরণে তাঁর, করি নমস্কার।

১৯০৪ সালের ২০ শে মার্চ, ৩৩ বছরের খ্রিস্টান ধর্মের মিশনারী মানুষ, দর্শন শাস্ত্রের পন্ডিত-প্রবর, চার্লস এন্ড্রুজ ভারতে এসে দিল্লির সেন্ট স্টিভেনসন কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছিলেন। এই সময়ে তিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসকের এবং শাসনের প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে প্রত্যক্ষ পরিচয় ৩বং অভিজ্ঞতা লাভ করেন,এবং তাই দেখে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন।

মহাবতার যিশুখ্রিষ্টের ভক্ত অনুরাগী এন্ড্রুজ উপলব্ধি করেছিলেন যে,খ্রিস্টান সমাজ এবং ইংরেজ শাসক ভারতবর্ষে যে পথ ধরে চলেছিল,সেই পথ আদৌ খ্রিস্টানধর্মের আদর্শ পথ ছিল না। এদেশের সাধারণ মানুষ নানানভাবে অত্যাচারিত হচ্ছিল ব্রিটিশ সরকার এবং শাসক দ্বারা।

সেই সময়েই মানবপ্রেমী মানুষ হিসাবে তিনি ভারতবর্ষের জীবনের সাথে নিজের চিন্তা ও ভাবনার যোগস্থাপনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ভারতের প্রতি ভেতর থেকে একটা টান অনুভব করছিলেন তিনি।

১৯১২ সালের জুন মাসে রবীন্দ্রনাথ ইংলন্ডে যান। সেখানেই রোদেনস্টাইনের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সাথে সি.এফ.এন্ড্রুজের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল।সেটি ছিল এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। সেখানে তিনি ভারতবর্ষকে জানার এবং চেনার জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে পথ ও উপায় জানতে চান।রবীন্দ্রনাথ তাঁকে স্বামী বিবেকানন্দের কথা বলেন–,তিনি বলেন–“If you want to know India,you know the Swami Vivekananda, everything is positive in his creation and views…”।

এরপর সব কিছু থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়ে ভারতের প্রতি ভালোবাসায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। সেই সময়ে তিনি একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন -“আমার প্রাণ চায় যথার্থ স্বাধীন ভারতের মূর্তিটি দেখবো। অথচ, দেশের বর্তমান অবস্থায় সেটি কি সম্ভব? পরাধীনতার ও দুর্নীতির পাপচক্র কেবলই আবর্তিত হয়ে চলেছে শাসক ও শাসিতের মধ্যে।”

১৯১৩ সালে মাদ্রাজের তুলো শ্রমিকদের ধর্মঘটের সমাধানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলেন।

সারাবিশ্বে যেখানেই নিপীড়ন চলেছে,সেখানেই তিনি নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ফিজি-তে শ্রমিকদের উন্নতির জন্য সেখানে চলে যান। তাদের পাশে ছিলেন তাদেরই একজন হয়ে।তারাই এন্ড্রুজকে “The Friend of the poors” বা “দীনবন্ধু” আখ্যায় আখ্যায়িত করেন।

১৯১৯ সালের ১৪ ই এপ্রিল(পয়লা বৈশাখের দিনে) অবিভক্ত ভারতবর্ষের পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ-এ ব্রিটিশ শাসক দ্বারা নৃশংস গণহত্যাকান্ডের ঘটনায় তিনি মর্মাহত হন,সেই সময় তিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে। তিনি এবং রবীন্দ্রনাথ স্থির করেছিলেন যে তাঁরা গান্ধীজিকে নিয়ে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ-এ যাবেন,সেই মর্মে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি নিয়ে এন্ড্রুজ সাহেব বোম্বেতে গান্ধীর কাছেও গিয়েছিলেন, কিন্তু গান্ধীজির কাছ থেকে নেতিবাচক কথা শুনে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসেন কলকাতায়। পরে রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদপত্র এবং নাইট পদত্যাগের কাজে তিনি রবীন্দ্রনাথের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরফলে ব্রিটিশ সরকার দীনবন্ধু এন্ড্রুজের গতিবিধির ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।

জীবনের বেশীরভাগ সময়ই তিনি শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছেন।নিজের যা কিছু ছিল, সব তিনি শান্তিনিকেতনে দান করে দেন মানুষের উপকারে কাজে লাগানোর জন্যে।

এক মহৎপ্রাণ মানুষ নিজের দেশ,আত্মীয়স্বজন ছেড়ে এই দেশে এসে হয়ে গিয়েছিলেন আমাদেরই একজন দরদী মানুষ। সারা ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন চিরকাল।

১৯৪০ সালের ৫ই এপ্রিল কলকাতার সেই সময়ের প্রেসিডেন্সি জেনারেল হসপিটালে(পি.জি./ SSKM) দীনবন্ধু এন্ড্রুজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে অমরত্ব লাভ করেন। লেখা হয়ে যায় ভারতবর্ষের একজন মহান মানব দরদী হিসাবে ইতিহাসের পাতায় চার্লস ফ্রিয়ার এন্ড্রুজের নাম।

Related posts

কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর, সে-দেহে তাহার কোন প্রমাণ ছিল না

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী