অর্ধেক আকাশ, অর্ধেক পৃথিবী, আজও উপেক্ষায়, আজও অবিচারে…

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

সেই কবে রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন,–“নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার,/কেন নাহি দিবে অধিকার?/ হে বিধাতা..”

কিন্তু আজও সমাজবিধাতাদের ভাবনা চিন্তায় এই শুভ মানসিকতার কোনও রকমের বাস্তব প্রামান্যতা মেলেনা। তারা তাদের ভাষনে,লিখনে,অনেক অনেক সুন্দর সাম্যবাদী,নারীবাদী কথা বলেন, লেখেন,কিন্তু বাস্তব প্র‍য়োগের সময়ে সেই যে কে সেই। ফলস্বরূপ এই বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা নারীসমাজের প্রতি সেই অসাম্য আজও রয়েই গেছে।হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি দেখা যায়,কিন্তু সেটুকুই সব নয়। তা বড়ই সামান্য। আজও নারী মানেই সে অনুকম্পার পাত্রী,সে দয়ার পাত্রী,সে পুরুষদের লালসা চরিতার্থ করার উপকরণ, সে বিজ্ঞাপনের চিত্তাকর্ষণ করার সামগ্রী,ইত্যাদি, ইত্যাদি।

যদিও এই সমাজ,এই সমাজের মাতব্বর সমাজপতিরা,এমনকি রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা জানেন,যে এই বিশ্বে, আজকের এই যুগে সমাজ ও সভ্যতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা কেউই পিছিয়ে নেই,তবুও সেই নারীদের একটি বিরাট অংশ আজও বিভিন্নভাবে অত্যাচারিত,উপেক্ষিত,অবহেলিত,বঞ্চিত।

কাজী নজরুল ইসলাম আধুনিক সভ্য সমাজকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন –“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যানকর,/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর..”। তবুও সেই অর্ধেক আকাশ,অর্ধেক পৃথিবী আজও উপেক্ষিত।

সদ্য “বিশ্ব নারী দিবস” পালিত হয়ে গেল ৪ঠা মার্চ। সেই প্রেক্ষিতেই বলা যায়,যে এই নারী দিবসের তাৎপর্যকে কি সত্যি আমরা সম্মান করতে পারি? সত্যি কি এই সভ্যতা,এই সমাজ নারীদের “একজন মানুষ” হিসাবে আজও যথাযথ সম্মান দেয়? অবশ্যই উত্তরটা হবে “না”। তার কারন হিসাবে বাস্তব কিছু তথ্যের মুখোমুখি যদি হই,তাহলেই জানা যাবে হয়তো।

সারা বিশ্বে নারী পুরুষের সমানাধিকার নিয়ে বিগত চতুর্দশ শতক থেকে উনবিংশ, বিংশ শতাব্দী অবধি অনেক আন্দোলন, অনেক আলোচনা,অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে পুরুষের সমপর্যায়ে স্বাধিকার,সম্মান দেওয়া হয়েছে।পাল্টানো হয়েছে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী।তবু্ও আজও সেই নারী তার ন্যায্য অধিকারের দাবী থেকে বঞ্চিত।

তার বাস্তব প্রমাণ হিসাবে বলা যায়, আজও, সারা পৃথিবীতে কর্মরত পুরুষের তুলনায় কর্মরত মহিলারা গড়ে ২০ শতাংশ কম পারিশ্রমিক পান,আর এই তথ্য পাওয়া যায় ২০১৯-২০ সালের International Labour Organisation এর Global Wage Report থেকে। আমাদের ভারতবর্ষে সেই ফারাকটা আরও বেশী। আমাদের দেশের গ্রাম এবং শহর,দুই ক্ষেত্রেই একইরকম কাজের জন্যে প্রায় সব জায়গাতেই মহিলাদের পারিশ্রমিক পুরুষের তুলনায় অর্ধেক(NSSO/2022-এর তথ্য অনুযায়ী)। যদিও সমপ্রকারের কাজের জন্য নারী-পুরুষের সমপরিমান পারিশ্রমিক পাওয়ার আইন ১৯৭৬ সালে দেশের সংবিধানে স্বীকৃতি লাভ করেছে,কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তা শুধু ঐ খাতায় কলমেই বন্দী হয়ে আছে আজও।

কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের পরিচালকরা মহিলাদের অনুদান নামক অনুকম্পা-দয়ার ভিক্ষা দিতে যতটা আগ্রহী, ততটাই তারা অনাগ্রহী মহিলাদের আইনসম্মত ন্যায্য অধিকারের পারিশ্রমিক সহ অন্যান্য ন্যায়সঙ্গত সুযোগ সুবিধাগুলি দিতে।

কেন্দ্রীয় সরকারের মানব উন্নয়ন দপ্তরের তথ্য বলছে,–সারা ভারতে পুরুষ শ্রমিকের গড়ে রোজগার গ্রামে ৩৯৩ টাকা এবং শহরে ৪১৯ টাকা। সেখানে নারী-শ্রমিকদের রোজগার গ্রামে ২৬৫ টাকা,এবং শহরে ৩৩৩টাকা। একই চিত্র পাওয়া যায় দেশের সমস্ত রাজ্যগুলিতে।

সংবিধানে রয়েছে শ্রমজীবী মহিলারা মাতৃত্বের ছুটি পাবেন ২৬ সপ্তাহ,মানে সাড়ে ৬ মাস।কিন্তু,বাস্তবে,সরকারি ক্ষেত্র বাদে,বাকী সব ক্ষেত্রেই প্রায় ৯০ শতাংশ নারী-কর্মীরা মাতৃত্বকালীন সবেতন ছুটি পাননা।ছুটি দাবী করলে কাজ থেকে ছাঁটাই হয়ে যান। এছাড়া আরও একটি ভয়ংকর অমানবিক তথ্য পাওয়া যায়,যে,এদেশের মহারাষ্ট্র রাজ্যে আখের চাষে যুক্ত প্রায় ৩০ হাজার মহিলা শ্রমিক বাধ্য হয়েছেন অপারেশন করে তাদের শরীরের “জরায়ু” বাদ দিতে।কারন,প্রাকৃতিক নিয়মে প্রতি মাসে ঋতুচক্রের দিনগুলিতে তারা কাজে না যেতে পারলে পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হন,এমনকি কাজ থেকে বরখাস্তও হয়ে যান।

এছাড়া রয়েছে আরও একটি মারাত্মক বিপদের ক্ষেত্র,সেটা হলো কর্মক্ষেত্রে নারীদের পুরুষ সহকর্মীদের দ্বারা কখনো কখনো যৌন নিগ্রহ,যৌন পীড়ন, ইত্যাদি,ইত্যাদি।

এখনও নারীদের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা,রাষ্ট্রব্যবস্থা যথাযথ মানুষ হিসাবে সম্মান দিতে শেখেনি। তার প্রমান হিসাবে বলা যায় ২০২২ সালের আগষ্ট মাসে রাশিয়াতে পুটিন সরকার পুনরায় ফিরিয়ে আনলেন “Mother Heroine” নামের প্রকল্পটি। যা অতীতে সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল। এই প্রকল্পে বলা হলো, যে সকল রাশিয়ান নারী ১০ বা তার বেশি সন্তানের জন্ম দেবেন তাদের এই সম্মান দেওয়া হবে,দেওয়া হবে ১০ লক্ষ রুবল্(রাশিয়ান টাকা)।

এর আসল কারণ হল, কোভিডে সে দেশের জনসংখ্যা কমে গেছে ২০১৯-২০-২১ সালে।এছাড়া রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে অনেক সেনা মারা গেছে,তাই দেশে জন সংখ্যা বাড়ানোর জন্যেই এই পরিকল্পনা। দেশের সেবার জন্যে এই পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে পুটিন বলেন,যে,–“যেসব পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি,সেসব পরিবারেই জাতীয়তাবোধ বেশি”। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৩৮ সালে জার্মানে হিটলারও চালু করেছিল “Mother’s Cross”। আর ১৯৩৯ সালে শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দীর্ঘমেয়াদি সামরিক শক্তি বজায় রাখতে,বহাল রাখতে ধারাবাহিক সেনা জোগানের প্রয়োজন, তাই ভবিষ্যতে জার্মান সেনানী জোগানকে অক্ষুন্ন রাখার জন্যই সেদেশে তখন আহ্বান করা হয়েছিল নারীদের (১৮ বছর থেকে শুরু করে) আদর্শ মা হয়ে ওঠার (আদর্শ মা মানে বহু সন্তানের জননী) পরিকল্পনা। বহু সন্তানের মায়েরা সম্মানিতও হতেন। একই জিনিষ ঘটেছিল ইংল্যান্ডের মাটিতে ১৭৫৬ সালে।শুরু করেছিলেন লন্ডন ফাউন্ডলিং হসপিটালের গভর্নর জেনারেল জন হ্যানওয়ে।

নারীর সহজাত পবিত্র আবেগ “মাতৃত্ব” বাসনাকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য পুরুষ শাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থা,সমাজব্যবস্থা কাজে লাগিয়েছে চিরকাল। তারা তাদের হিসাবেই রাখেনা, নারীর স্বাস্থ্যের ব্যাপার টি। বেশি সন্তান ধারনের ফলে নারীর শারিরীক সুস্থতা নিশ্চিতভাবেই বিঘ্নিত হয়।তার শরীর অপুষ্টিতে ভোগে। শিশুকে পালন করতে গিয়ে তার ব্যক্তিগত শখ আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিতে হয়,ইত্যাদি ইত্যাদি।

এইভাবেই আজও নারীরা কি সমাজ ব্যবস্থা,কি রাষ্ট্র ব্যবস্থা,সবক্ষেত্রেই শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছেন। কিন্তু তার শারীরিক সম্মান, তার মানসিকতার গুরুত্ব, তার অর্থনৈতিক সমানাধিকার,ইত্যাদি,কোন কিছুতেই এইসব সমাজের মাথাদের কোন মাথাব্যাথা নেই।

আজও তাই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি,উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করার জন্য দখল করতে চায় পরের জমি এবং যোনী।ফলে,ছলে বলে কৌশলে যেমন জমি দখলের লড়াই চলে,ঠিক তেমনই চলে ছলে বলে কৌশলে “মাতৃযোনী” দখলের লড়াই।ফলে সমাজে,যেকোন পরিস্থিতিতে,দাঙ্গায়,যুদ্ধে, কাজের ক্ষেত্রে নারীর শরীরের ওপর চলে দখলদারত্বের জোরজুলুম।

মানব সভ্যতার দুটি সম্প্রদায়, এক নারী,দুই পুরুষ। সমাজের,দেশের, সভ্যতার, পরিবারের যাবতীয় উন্নয়ন,সমৃদ্ধি –এই দুই সম্প্রদায়ের যৌথ প্রচেষ্টায় সংঘটিত হয়েছে,ইতিহাস তাই বলে।তবুও আজও সেই ইতিহাসের অর্ধেক অধ্যায় এই নারী সমাজ অবহেলিত,অপমানিত, উপেক্ষিত।

শুধু একদিন নারী দিবসের উদযাপনের মধ্যে দিয়ে আমাদের সভ্যতার সেই ত্রুটিগুলো সংশোধন করা যাবেনা।তার জন্য প্রয়োজন প্রাত্যহিক অভ্যাসে আনা সেই চিন্তা ভাবনা, যেখানে নারী পাবেন একজন মানুষের মত সমস্ত রকমের সমাধিকারের সম্মান,সমাদর,প্রাধান্য।তবেই আমাদের এই সভ্যতার যথার্থ উন্নয়ন ঘটবে।নচেৎ,কখনোই তা পূর্ণাঙ্গতার সর্বাঙ্গীণতা পাবেনা।

এই বিশ্বের সকল নারীর প্রতি রইল অভিনন্দন,শুভেচ্ছা, বিনয়ী ভালোবাসা এবং বিনম্র শ্রদ্ধা।

Related posts

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

চৈত্র বৈশাখ মধুমাধবের মায়ায় মায়ায়