মহাতীর্থ দক্ষিণেশ্বর…এক অলৌকিক পীঠস্থান

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

১৮৪৭ সাল…জানবাজারের রানিমা কাশীতে শ্রীবিশ্বনাথ ও মা অন্নপূর্ণার পুণ্যদর্শন করতে যাবেন, বহুদিনের মনের সাধ, তাই চলছে তারই তোড়জোড়। ২৪টি বড় বড় সাজানো গোছানো বজরায় আত্মীয়-স্বজন, দাসদাসী, খাবারের রসদ, ইত্যাদি ইত্যাদি রাখারাখি, থাকাথাকির ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। পরেরদিন সেই মহাপুণ্যের শুভযাত্রা।

সেইদিনই রাত্রে জানবাজারের রানি রাসমণিদেবী স্বপ্নে পেলেন ত্রিভুবনেশ্বরী জগজ্জননীর আদেশ…”কাশী যাওয়ার দরকার নেই, তুই আমাকে এখানেই প্রতিষ্ঠা কর, আমি তোর হাতে পুজো নেব, আমি তোর কাছেই থাকব..এখানেই আমার মন্দির প্রতিষ্ঠা কর…।”

স্বপ্নের মধ্যেই রানিমা দেখলেন স্বর্গীয় মহিমায় মহিমান্বিত, আলোয় আলোয় আলোকিত দেবীমায়ের এক অনির্বচনীয় রূপ-লাবণ্যের স্বর্গীয় দ্যুতিময় আনন্দ। ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়লেন রানিমা। তখনই বাড়ির সকলকে ডাকলেন। বিশেষ করে সেজো জামাই মথুরামোহন বিশ্বাস-কে। স্বপ্নের কথা সব খুলে বললেন, আর তার সঙ্গে এও বললেন, কাছাকাছি মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য স্থান নির্বাচন করার কথা যত শীঘ্র সম্ভব।

রানিমার আদেশ, …তাই যথারীতি সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠল। প্রথমে জায়গা দেখা হল রানিমার বাপের বাড়ির কাছে হালিশহরে। কিন্তু,সেখানে নানান জটিলতা। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে শেষমেষ পাওয়া গেল গঙ্গার পাড়ে দক্ষিণেশ্বর নামে একটি গ্রামে জায়গা। এই দক্ষিণেশ্বর জায়গার প্রাচীন নাম হল শোনিতপুর-সম্বলপুর। কথিত আছে এখানেই নাকি পুরাকালে বানরাজা দেবাদিদেব মহাদেবের সাধনা করেছিলেন, আর সেই বিগ্রহের নাম ছিল দেবাদিদেব দক্ষিণেশ্বর। সেই থেই এই জায়গার নাম দক্ষিণেশ্বর।

যাইহোক, সেখানেই ২০ একর জায়গা পাওয়া গেল,যার মালিকের নাম ছিল জন হেস্টি। তিনি এখানে প্রভু যিশুর ভজনা করতেন। এই জমির একধারে ছিল মুসলমানদের কবরস্থান এবং দরগা।

সেই জায়গা রানিমা কিনে নিলেন। শুরু হল মায়ের স্বপ্নাদিষ্ট মন্দির প্রতিষ্ঠা করার কাজ। ১৮৪৭ সাল থেকে ১৮৫৫ সাল অবধি ৮ বছর ধরে চলল মন্দির নির্মাণের কাজ। মোট খরচ হয়েছিল তখনকার দিনে ৯ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা।

মায়ের মন্দির, নাট মন্দির, দ্বাদশ শিব মন্দির, কৃষ্ণ রাধিকা, গোপালের মন্দির, রঘুবীরের মন্দির, প্রভৃতি।

ইতিমধ্যে রানিমা রাজস্থানের জয়পুর থেকে কষ্টিপাথর আনিয়ে তৈরি করিয়েছিলেন মা ভবতারিণীর মূর্তি। আর সেই মূর্তি সুরক্ষিত করে এক বিশাল সিন্দুকের মধ্যে রেখেও দিয়েছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরের লীলা কেইবা বোঝে। তাই, আবার একদিন দেবী মায়ের স্বপ্নাদেশ…”আমাকে প্রতিষ্ঠা কর তাড়াতাড়ি, আমি এই সিন্দুকের মধ্যে ঘেমেনেয়ে উঠেছি, আমাকে মন্দিরে নিয়ে চল। প্রতিষ্ঠা কর তাড়াতাড়ি।”

অতএব, শুরু হয়ে গেল জোর কদমে প্রস্তুতি। অনেক বাধা বিপত্তির শেষে ঝামাপুকুরের এক পন্ডিত ব্রাহ্মণ কামারপুকুরের রামকুমার চট্টোপাধ্যায় দায়িত্ব নিলেন মায়ের পুজার এবং মাতৃ-প্রতিষ্ঠার। আর তাঁর সহকারী হিসাবে এলেন তাঁরই আপন ছোটভাই গদাধর চট্টোপাধ্যায়।

১৮৫৫ সালের ৩১ মে( বাংলার ১২৬২ বঙ্গাব্দের ১৮ জ্যৈষ্ঠ, বৃহস্পতিবার) স্নানযাত্রার দিনে মহা সমারোহে প্রতিষ্ঠিত হলেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে জগজ্জননী মা ভবতারিণী।

এই প্রতিষ্ঠার আগে ১৮৫৫ সালের আজকের দিনে অর্থাৎ ২৮ মে প্রথম দক্ষিণেশ্বরে পা রাখেন ১৯ বছরের গদাধর চট্টোপাধ্যায় (জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারী, ১৮৩৬ সাল), যিনি পরবর্তীকালে সারাবিশ্বে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব হিসাবে প্রণমিত হবেন। যিনি একই জীবনে সনাতন ধর্মের, মুসলিম ধর্মের, খ্রিস্টান ধর্মের প্রত্যক্ষ সাধনা করেছেন। সাধনা করেছেন সাকার নিরাকার ব্রহ্মের। সাধনা করেছেন অদ্বৈত বাদ থেকে বহুত্ববাদীতার। আর এই সব সামগ্রিক সাধনার শেষে যিনি বলেছিলেন,…”সকল ধর্মই,সমান। কেউ বলে জল, কেউ বলে পানি, কেউ বলে ওয়াটার,… সবই তো পিপাসার শান্তির জন্য। অতএব, যত মত তত পথ…আসলে জীবের মধ্যেই শিব আছেন, শিব জ্ঞানে জীবের সেবা করাই আসল ধর্ম…”।

এই সেই দক্ষিণেশ্বরের মায়ের মন্দির, যেখানে আধুনিক পৃথিবীর মানুষের কাছে “যত মত তত পথ”-এর এক ঐতিহাসিক মন্ত্রের উদগাতা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জাগতিক এবং ঐশ্বরিক লীলাক্ষেত্র। এই সেই দক্ষিণেশ্বরের মন্দির, যেখানে সারা বিশ্বের সকল ধর্মের মানুষ একত্রিত হয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণের অলৌকিক আহ্বানে। ফরাসি মনিষী দার্শনিক রোমাঁ রোঁলা লিখেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনকথা। জার্মান দার্শনিক ম্যাক্সমুলার লিখেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনকথা। ব্রাহ্ম সমাজের নেতা কেশবচন্দ্র সেন, সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রিন্সিপাল ফাদার জন হেস্টি, নাখোদা মসজিদের ইমাম, ব্রহ্মজ্ঞানী তোতাপুরি,সাধিকা ভৈরবী মা, আগরপাড়ার বৈষ্ণবী সাধিকা গোপালের মা, প্রমুখ। এই দক্ষিণেশ্বর মহাতীর্থের আকর্ষণে আকর্ষিত হয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, লোকনাথ ব্রহ্মচারী, তারাপীঠের সাধক বামাক্ষ্যাপা, কাশীর চলন্ত জীবন্ত শিব ত্রৈলঙ্গ স্বামী, মহাকবি গিরিশচন্দ্র ঘোষ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমুখ।

এ ছাড়াও এই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সেই সময়ের ঐতিহাসিক লীলাময় দিনগুলোতে এখানে এসেই নানান বয়সের অনেক মানুষ দেবত্বে উত্তীর্ণ হয়েছেন। যেমন স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ, স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ,স্বামী সারদানন্দ,স্বামী ত্রিগুনাতিতা নন্দ,লাটু মহারাজ,শ্রী মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত(মাস্টার মশাই/ শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত যার লেখা)উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বসুমতী পত্রিকা,বসুমতী সাহিত্য মন্দির-এর প্রতিষ্ঠাতা),ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার, শ্রী মা সারদা(শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের লীলাশক্তি),শ্রী অন্নদা ঠাকুর (আদ্যাশক্তি আদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠাতা)স্বামী অদ্বৈতানন্দ,স্বামী গম্ভীরানন্দ,স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী শিবানন্দ,শিবনাথ শাস্ত্রী, স্বামী অদ্ভুতানন্দ,স্বামী অখণ্ডানন্দ,স্বামী যোগানন্দ,স্বামী ত্রিগুনাতিতানন্দ,স্বামী নিরঞ্জনানন্দ,স্বামী সুবোধানন্দ,অক্ষয় কুমার সেন,অশ্বিনীকুমার দত্ত( শ্রী অরবিন্দের দাদামশাই), সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বৈদ্যনাথ বসু,মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডাক্তার রামচন্দ্র দত্ত,ম্যাজিস্ট্রেট অধরলাল সেন,বিপ্লবী ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়,ভারত সরকারের রাষ্ট্রদুত বিশ্বনাথ উপাধ্যায়, সুপারিন্টেনডেন্ট অফ একাউন্টস জেনারেল অফ ইন্ডিয়া ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বলরাম বসু,দুর্গাচরন নাগ,প্রমুখ প্রমুখ অসংখ্য মানুষ।

এই ইতিহাস এক অনন্ত ইতিহাস। এতো অল্প পরিসরে তা পুরো বলা সম্ভব নয়। এককথায় বলা যায়, বাংলা তথা ভারতবর্ষের নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ ছিল এই দক্ষিনেশ্বর এবং সেখানকার এই পরিমন্ডল।যা সারা পৃথিবীতে এক ঐতিহাসিক পটভূমি সৃষ্টি করেছিল। যা সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের এক নতুন পথের দিশা দেখিয়েছিল।

আজ সেই ২৮ মে…যেদিন ১৮৫৫ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রথম পদধুলি দিয়েছিলেন দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহকারী হিসাবে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে মা ভবতারিণীর শ্রীচরণকমলের পাদপদ্মে…আজ এই পবিত্র পূণ্য দিনে রইল মহাতীর্থ দক্ষিণেশ্বরের প্রতি আমাদের অন্তরের সশ্রদ্ধ বিনম্র প্রণাম।

Related posts

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

চৈত্র বৈশাখ মধুমাধবের মায়ায় মায়ায়