পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
সময়টা আজ থেকে ২০০ বছর আগেকার কথা। আমাদের এই বাংলার মাটিতে নেমে এসেছিলেন এক অন্য রকমের বাঙালী মানুষ। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (শর্মনঃ/ শর্মা)।
সেই ঈশ্বরচন্দ্র যখন ১১ বছরের তখন বাংলার নবজাগরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় যিনি ছিলেন হিন্দু কলেজের অধ্যাপক, যিনি বাঙালীকে যুক্তি বিজ্ঞানের সাথে পরিচয় করিয়েছিলেন, সেই হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও মারা গেলেন। ঈশ্বরের বয়স যখন ১৩, তখন মারা গেলেন ভারতের নবজাগরনের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়।
সেই ঈশ্বরচন্দ্র পরবর্তীতে হলেন ” বিদ্যাসাগর”। সমসাময়িক হিসাবে পেলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, পেলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তকে, মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে, পেলেন ভারতপ্রেমী ড্রিঙ্কিংওয়াটার বীঠন সাহেব কে, (যাকে আমরা চিনি বেথুন সাহেব হিসাবে)। পেলেন বয়সে ছোট শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে, পেলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। পেয়েছিলেন পুত্রবৎ রবীন্দ্রনাথকে,নরেন্দ্রনাথ দত্তকে (স্বামী বিবেকানন্দ), বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখকে। কন্যাবৎ পেয়েছিলেন প্রথম মহিলা চিকিৎসক ডাক্তার কাদম্বিনী বসু(গঙ্গোপাধ্যায়), চন্দ্রমুখী বসুকে-কে।
বিদ্যাসাগরের কথা আলোচবা করতে গেলে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের কথা,তিনি বিদ্যাসাগর সম্মন্ধে লিখেছেন -” বিদ্যাসাগরের কথা আলোচনা করবার সময়ে আমাদের চিন্তা বাঙালীত্বের দিকে বা হিন্দুত্বের দিকে নিয়ে যায়না। নিয়ে যায় মনুষ্যত্বের পরম লক্ষ্যের দিকে”।
হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন।কারন শত সমস্যায় জর্জরিত সেই সময়ের বাংলা তথা ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের একমেবাদ্বিতীয়ম্ পথিকৃৎ ছিলেন আমাদের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
তখন বাংলা তথা ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে নেই লেখাপড়া। নেই নারীশিক্ষার প্রচলন,।তারসাথে ছিল মেয়েদের বাল্যবিবাহ এবং বাল্য বৈধব্য। সে এক মর্মান্তিক সামাজিক অন্যায় অবিচারের চিত্র। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে প্রায় একা ঈশ্বরচন্দ্র সেইসব মেয়েদের শিক্ষা,বাল্য বিধবাদের পুনরায় বিবাহের কথা ভেবেছিলেন। বিদ্যাসাগরের এই ভাবনা ছিল তখনকার সমসাময়িক সমাজের সমাজপতিদের ভাবনার চেয়ে কয়েক সহস্র যোজন এগিয়ে। কিন্তু,সেই রক্ষণশীল সমাজের সমাজপতিরা একসাথে বিদ্যাসাগরের চরম বিরোধিতা শুরু করেছিল,এমন কি প্রাণে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রও করেছিল। তখনকার ব্রিটিশ সরকারের বড়লাট লর্ড ডালহৌসি-ও সেই প্রচন্ড বিরোধিতার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু করতে বা বলতে পারেন নি। পিছু হটেছিলেন।
তখন সমাজ সংস্কারের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন একা বিদ্যাসাগর। তিনি সমস্ত শাস্ত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করে অবশেষে, বাইবেলে, কোরানে, এবং পরাশর সংহিতায় খুঁজে পেয়েছিলেন মেয়েদের পুনর্বিবাহের শাস্ত্রবিধি। পরাশর সংহিতায় লিখছে- “নষ্টমৃতে প্রব্রজিতে,ক্লীবেচ পতিতেপতৌ/ পঞ্চস্বাপৎ মু নারীনাং পতিরন্য বিধীয়তে”।
সারা বাংলা,তথা ভারত জুড়ে শুরু হল বিধবা বিবাহের প্রস্তাবের আইন প্রচলনের জন্য পক্ষে বিপক্ষের সই সংগ্রহ। আশ্চর্যের বিষয়,বিরোধিতা করলেন রাজা রাধাকান্ত দেব সহ প্রায় সকল সামন্ত জমিদার রা।বিরোধিতা করলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, “সংবাদ প্রভাকর” পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্ত, প্রমুখ সুশিক্ষিত বাঙালী সমাজের একাংশ । তাই প্রস্তাবের পক্ষে সই করলেন ৯৮৭ জন,আর প্রস্তাবের বিপক্ষে সই করলেন ৩৬৭৬৩ জন।
তারপর অনেক আলোচনায় বিধবা বিবাহের প্রস্তাবের আইন প্রচলনের ব্যবস্থা সরকারীভাবে চালু হয়েছিল। আজ এই ২০০ বছর পরে যখন সারা দেশে ঘরে ঘরে মেয়েদের পড়াশোনা,তাদের অগ্রগতি, ইত্যাদি, এইসবের পেছনে রয়েছে সেদিনের এই জেদী মানুষটির একাকী লড়াই করার ইতিহাস।যা আমাদের কাছে স্মরণীয়, বরনীয়।প্রণম্য চিরদিনের জন্য।
বিদ্যাসাগরের সম্মন্ধে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাই বলেছিলেন-“তাঁর মধ্যে প্রাচীণ ভারতীয় ঋষিদের প্রজ্ঞা,পাশ্চাত্ত্যের উদ্যম,আর বাঙালী মায়ের হৃদয় ছিল…।”
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বিদ্যাসাগরে সাথে সাক্ষাৎকারে আনন্দিত হয়ে বলেছিলেন– “এতদিন খাল,বিল,নদী দেখেছি।আজ সাগর দেখছি..।”
স্বামী বিবেকানন্দ বিদ্যাসাগর সম্মন্ধে শ্রদ্ধায় বলেছিলেন – “সমগ্র উত্তর ভারতে আমার বয়সী এমন কোনও মানুষ নেই,যার ওপর ওনার প্রভাব পড়েনি..।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-“বাঙালী গড়তে গড়তে বিধাতা যে কী করে ঈশ্বরচন্দ্র বানিয়ে ফেললেন, সেটা অতীব আশ্চর্যের…। “
আধুনিক বাংলা ভাষার অক্ষর বিন্যাস,সেতো বিদ্যাসাগরেরই সৃষ্টি।আজ এই যে নারী পুরুষের শিক্ষাতে অগ্রসর হওয়া,সেতো বিদ্যাসাগরের জন্যই।তিনিই তো প্রথম এই বাংলার গ্রামে গ্রামে ইস্কুল, পাঠশালা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যার প্রভাব পড়েছিল সারা দেশে। তিনিই তো প্রথম গ্রামের চাষীদের জন্যে,গরীবমানুষের জন্যে সমবায় ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। এমন কি শেষ বয়সে যখন তিনি বাঙালির ওপরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন এই বাংলা ছেড়ে সুদুর তখনকার ছোট নাগপুরের(এখন ঝাড়খণ্ড) মধুপুর এবং জামতারার মাঝখানে কার্মাটাঁড়ে (এখন সেখানকার ষ্টেশনের নাম “বিদ্যাসাগর”), সেখানকার আদিবাসীদের সাথে তাদের আপন একজন হয়ে বসবাস করেছিলেন,সেখানেও তিনি তাদের পড়াশোনার জন্য স্কুল করেন,তাদের চিকিৎসা তিনি নিজে হোমিওপ্যাথি পদ্ধতিতে করতেন,তাদের মধ্যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন।চালু করেছিলেন তাদের জন্য সমবায় ব্যবস্থা। বন্ধ করেছিলেন আদিবাসীদের নেশাভাঙ করার প্রবনতা। হয়ে গিয়েছিলেন,তাদেরই একজন আত্মার আত্মীয়।
সে আর এক ইতিহাস।
এক কথায় বলা যায়,বিদ্যাসাগরের আলোচনার শুরু আছে,কিন্তু কোনও শেষ নেই।কারন তিনি বিশাল,অসীম, অতল, মায়ের স্নেহময় অনুভুতি দিয়ে গড়া এক মহৎপ্রাণ মানুষ।
আবার অপরদিকে তিনিই সেই জেদী এক কথার ব্যক্তি,যিনি অন্যায়ের সাথে কখনোই কোনওদিন কোনওভাবেই আপোষ করেন নি।শেষ অবধি সেই অন্যায়কে চিরদিনের জন্য দূরীভুত করার লক্ষ্যে ছিলেন এক ইস্পাত কঠিন স্বভাবের, চরিত্রের, মনোভাবের কঠিন মানুষ।
তাই তিনি আমাদের গৌরব, তিনিই আমাদের একমাত্র ঈশ্বর।আমাদের আপনজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
তাঁর চরণ ছুঁয়ে যাই.. বিনম্রতায় প্রণাম রেখে যাই।