৩০ এপ্রিল, এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদের দিন এবং রবীন্দ্রনাথ…

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

সারা বিশ্বের মানব সভ্যতার আধুনিক যুগের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত ঘটনা হল ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অবিভক্ত ভারতবর্ষের পঞ্জাব প্রদেশের জালিয়ানওয়ালাবাগ-এর নৃশংসতম অমানবিক ঘটনা।

আমরা সকলেই জানি সেদিন পঞ্জাবের শাসক জেনারেল ও. ডায়ারের নির্দেশে সেখানকার পুলিশকমিশনার মি: আর.এল. ডায়ার বিকেল ৪/৪.৩০ টের সময় জালিয়ানওয়ালাবাগ-এর তিন দিক ঘেরা একটি উদ্যানে পঞ্জাবের বৈশাখী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-এ সমবেত হওয়া নানান বয়সের নারী-পুরুষের উপর গুলি চালিয়েছিল। এবং তৎক্ষণাৎ প্রায় ১৬০০ জন মানুষ সেই গুলিতে খুন হয়েছিলেন। উদ্যানের মাঝখানে একটি কুয়ো ছিল, প্রাণ বাঁচাতে সেই কুয়োতে প্রায় ৪০০/৫০০ জন মানুষ ঝাঁপ দিয়েছিল, কিন্তু তারা মারা গিয়েছিল। জালিয়ানওয়ালাবাগ-এর মাটিতে, সবুজ সবুজ ঘাসের বাগিচায়, তিন দিকের ঘেরা পাঁচিলের দেওয়ালে তরতাজা মানুষের খুন হয়ে যাওয়া টকটকে লাল রক্তের স্রোত। চারিদিকে আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস আক্রান্ত। সে কী মর্মান্তিক এক ঘটনা, যা মানুষের অত্যাচারের ইতিহাসের বিরলতম এক ঘটনা। যা মানুষের মনুষ্যত্বকে লজ্জা দেয়, কাঁদায়, ক্ষুব্ধ করে তোলে প্রতিবাদের আগুনে। রাগে অগ্নি দগ্ধ হয় মানবাত্মা।

যাইহোক, আজকের দিনের মতো তখন সংবাদ পরিবেশনের এত আধুনিক ব্যবস্থা ছিল না, তার উপর ব্রিটিশ সরকার সেই খবর যাতে বাইরে না বেরিয়ে যেতে পারে তার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। তবুও সেই খবর বাইরে বেরিয়েছিল বিভিন্ন ভাবে। বিভিন্ন সূত্র দিয়ে সারাবিশ্বে সেই খবরের টুকরো টুকরো ঘটনা যেই শুনেছে সেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

তাঁদের অন্যতম ছিলেন আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ক্ষোভে-দুঃখে ফেটে পড়েন। গান্ধীজির কাছে বন্ধু মিঃ. সি.এফ.এন্ড্রুজ ( Charles frederic Endruez)-কে অনুরোধ-সহ চিঠি লিখে পাঠান যে কবিগুরু এবং মহাত্মা গান্ধী দু’জনে পঞ্জাবে যাবেন, সেইসব অসহায় মানুষদের পরিবারের পাশে সেই মুহুর্তে দাঁড়ানোর জন্য। এবং তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করা যায় সেইমতন মহাত্মা গান্ধী প্রস্তুতি নিন, কবিগুরু স্বয়ং প্রস্তুত।

মহাত্মা গান্ধী তখন বোম্বেতে। তিনি মিঃ এন্ড্রুজকে বললেন যে, তিনি সেই মুহূর্তে ব্রিটিশকে বিরক্ত করতে চান না, তাই তিনি কবিগুরুর এই প্রস্তাবকে খারিজ করে দেন। কলকাতায় ফিরে এলেন মিঃ. এন্ড্রুজ। সব বললেন কবিকে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন স্থির করলেন তিনি একাই জালিয়ানওয়ালাবাগ-এর নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদ করবেন। এবং যথারীতি তাই করলেনও। ব্রিটিশ রাজের দেওয়া সম্মাননা “নাইটহুড” উপাধি তিনি লিখিত ভাবে জালিয়ানওয়ালাবাগ-এর ঘটনার প্রতিবাদে ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান ও পরিত্যাগ করেছিলেন।

সেই লিখিত চিঠি তিনি তখনকার লাটসাহেবের কাছে পাঠিয়েছিলেন আজকের দিনে, ৩০ এপ্রিল, ১৯১৯ সাল।
কবিগুরু লিখেছিলেন প্রতিবাদপত্রটি আগের দিন ২৯ এপ্রিল। সেই সময়ে উপস্থিত ছিলেন মিঃ সি.এফ. এন্ড্রুজ, তরুণ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, প্রমুখরা।

সেই হিসাবে আজ ৩০ এপ্রিল এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদের দিন, যা আমাদের শেখায় কবিগুরুর কথাতেই…” চিত্ত যেথা ভয় শূন্য উচ্চ যেথা শির..”।

আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।

Related posts

কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর, সে-দেহে তাহার কোন প্রমাণ ছিল না

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী