পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
পরমপুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব একবার এক অনুগামীকে তিরস্কার করে বলেছিলেন,-“ভক্ত হবি,ঈশ্বরে বিশ্বাস করবি,তা বলে বোকা হবি কেন?”
এই কথা অত্যন্ত বিজ্ঞান সম্মত এবং বাস্তব সম্মত।কারণ,তিনি যা বলেছেন তার মানে এই দাঁড়ায় যে, সাধারণ কান্ডজ্ঞান দিয়ে,সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে,লৌকিক হিত-অহিত বিচারের ক্ষমতা মানুষের থাকবে না কেন? এটাই তো মানুষের সহজাত কবচ-কুন্ডল। অর্থাৎ, পরম্পরাগতভাবে ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা,বিশ্বাস এক জিনিস আর অন্ধ বিশ্বাসে কূপমন্ডুকতা আর এক জিনিস। “অন্ধ মানসিকতা মানুষের বিচার বিশ্লেষণের বোধকে,বিবেককে নষ্ট করে দেয়”।(স্বামী বিবেকানন্দ)
মনে পড়ে,বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের “গণশত্রু” সিনেমার কাহিনির প্রেক্ষাপট?
সেই কাহিনীই যেন বাস্তবতায় ফিরে এল আমাদের জীবনে, আমাদের অভিজ্ঞতায় এই ২০২৫ সালের মহাকুম্ভমেলার পূণ্যস্নানে। এই পূণ্যস্নানের আশায় কোটি কোটি সর্বস্তরের মানুষ যে নদী-সঙ্গমে স্নান করলেন,তার জল রোগজীবানুতে দূষিত। প্রয়াগরাজে গঙ্গা,যমুনা,সরস্বতীর সঙ্গমস্থল থেকে জলের নমুনা পরীক্ষা করে এই তথ্যতে জাতীয় পরিবেশ আদালতের (National Green Tribunal) কাছে Central Pollution Control Board জানিয়েছেন যে, এই জল মানুষের স্নানের,ব্যবহারের আদৌ যোগ্য জল নয়।
সালমোনেলা,
ই-কোলাই,সহ নানান ধরনের আন্ত্রিক,চর্মরোগ,সৃষ্টিকারী মারাত্মক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি নিরাপদ মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী রয়েছে।কিন্তু কারণটা কি? কারণ টা হোল,স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজনের ভিত্তিতে পূণ্যার্থীদের জন্য কয়েক লক্ষ অস্থায়ী শৌচাগার তৈরি করা হয়েছে, হাজার হাজার টন ব্লিচিং পাউডার,ফিনাইল, ন্যাপথলিন,চারিদিকে ছড়ানো হয়েছে, মানববর্জ্য পদার্থ এবং তার আনুষঙ্গিক সমস্ত নোংরা জল গিয়ে পড়ছে গঙ্গা যমুনা, সরস্বতীর সঙ্গমে।এবং তা বিপুল বিপুল পরিমানে। pollution control board জানাচ্ছে যে গত নভেম্বরে প্রয়াগে কোলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ছিল জলে নিরাপদ মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এরসাথে প্রায় আড়াই লক্ষ নালা থেকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে,অবিরাম সমস্ত বর্জ্য পদার্থ এসে মিশছে সঙ্গমে।দুষিত হচ্ছে সঙ্গমের মহাকুম্ভ স্নানের জল। তাতে স্নান করছেন মানুষ। গন্ডুষ করে মুখে নিচ্ছেন,খাচ্ছেনও সেই জল পবিত্র বিশ্বাসে। পরিণতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পূণ্যার্থীগণ। রোগাক্রান্ত হচ্ছেন তাঁরা। তাহলে কি করনীয়?
এখানেই শ্রীরামকৃষ্ণ-এর সেই অমৃত কথা–” সবকিছু ঠিকঠাক যাচাই করে নিবি।হুজুগে কিচ্ছুটি করবিনি।”
এই অবস্থা বা ঘটনা আমাদের দেশে প্রায়শই হয়। এছাড়াও আরেকটি ঘটনা কোনও মেলা বা উৎসব অনুষ্ঠানে মানুষের পদপিষ্ট হয়ে অসহায় মৃত্যু আমাদের দেশে ঘটে দেখেছি। এবারে এই মহাকুম্ভস্নান অনুষ্ঠিত প্রয়াগরাজেও ঘটেছে।কয়েক হাজার মানুষ পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন।
যাতায়াতের ট্রেনের ব্যবস্থাও জানা যাচ্ছে সঠিক পরিষেবা দিতে।পারেনি সাধারন যাত্রীদের।
এইসব অব্যবস্থাকে অতিক্রম করেই এইসব মেলা অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার।আর তার জন্য সুদক্ষ,শৃঙ্খলাপরায়ন,টাস্কফোর্স গঠন করে সমস্ত অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে।কোনও প্রকারের ঢিলেমি বরদাস্ত করলে চলবে না। কারন আগে মানুষ, আগে মানুষের নিরাপত্তা,তার সুরক্ষা।এটা আমাদের মাথায় রাখা দরকার। শুধু ধর্মীয় আবেগ নয়।
তাই এই সঙ্গমে দুষন,মানুষের অকাল মরণ,ইত্যাদি অনভিপ্রেত ঘটনাগুলিকে ঠেকানো অতি অবশ্যই দরকার।যদি আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দায়সারা পরিকল্পনা না করে,অত্যন্ত বাস্তবসম্মত,এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা করতে পারি,আর তার প্রয়োগ যদি দায়িত্বশীল প্রশাসনিক ব্যক্তিদের দ্বারা করানো হয়,তাহলে আশা করা যায়, এই সঙ্কটের মোকাবিলা আমরা করতে পারবো।
মনে রাখতে হবে,যে মানুষের আবেগকে সম্মান দিয়ে,যথাযথ মর্যাদা দিয়েই প্রশাসনকে এই কাজ করতে হবে। মনে রাখা দরকার,যে আমরা মাত্র কয়েক বছর আগে কোভিডের মতো মারাত্মক মহামারীর মোকাবিলা করেছি। তাই সাধারণ মানুষের স্বার্থে প্রশাসন আরও বেশি তৎপর হোক,এটাই যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের, নাগরিকের একান্ত অনুরোধ সহ দাবী।