“আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো, তবু আমারে দেব না ভুলিতে…”, মহাপ্রয়াণে প্রণামে প্রণামে কাজী নজরুল ইসলাম

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

বাংলা ও বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে,তার পঠন পাঠনে,তার সংস্কৃতিতে,আলাপ আলোচনায় অবশ্যই থাকেন রামমোহন, বিদ্যাসাগর,শ্রীচৈতন্য শ্রীরামকৃষ্ণ,শ্রীমা সারদা,স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নেতাজী সুভাষচন্দ্র,কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখরা।

কাজী নজরুল ইসলাম তো বাংলা কবিতা এবং সঙ্গীতের এক ঐতিহাসিক ব্যক্তি।বাঙালির শৈশব কেটেছে নজরুলের কবিতায়.. “ভোর হল,দোর খোল খুকুমণি ওঠো রে,//ঐ ডাকে জুঁই শাখে ফুলখুকি ছোট রে..”। কিম্বা, “বাবুদের তালপুকুরে,হাবুদের ডাল কুকুরে,সে কি ব্বাস করলো তাড়া,বলি থাম্ একটু দাঁড়া..”।

আমাদের জীবনের ছোটবেলা থেকে বড়োবেলা অবধি রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি কাজী নজরুল ইসলাম উজ্জ্বলতায় বিরাজমান ছিলেন,আছেন এবং থাকবেন।

১৮৯৯ সালের ২৪ শে মে ( বাংলার ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬) তারিখে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়াতে নজরুলের জন্ম।অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।অল্প বয়সে বাবা মারা যান। ছোটবেলায় নজরুলের ডাক নাম ছিল দুখু মিয়াঁ।

অভাবের তাড়নায় পড়াশোনা তেমন করতে পারেন নি।পাউরুটি তৈরির কারখানায় চাকরের কাজ করেছেন। মাটি কুপিয়েছেন।তারপর লোকের বাড়ির ফাই ফরমাশ খেটেছেন,ইত্যাদি ইত্যাদি।এইভাবেই জীবন কেটেছে তাঁর।

এই নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ্বের সময়ে ৩৯ নম্বর বেঙ্গলী পল্টনে যোগ দেন,এবং সিপাহি হাবিলদার হিসাবে বাংলা থেকে চলে যান প্রথমে করাচী,তারপর আরবের বিভিন্ন স্থানে।

যুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালে তিনি চলে আসেন কলকাতায়। কলকাতার কলেজ স্ট্রিট এলাকায় ৩২ নম্বর বাড়িতে মুজফফর আহমেদের সাথে নজরুল বসবাস করতে থাকেন।এরপর কিছুদিনের জন্য ৩/৪/১ এ, তালতলা লেনে একটি বাড়িতে ভাড়া চলে যান।
১৯২০ সাল থেকেই নজরুলের সাহিত্য সঙ্গীত জীবন শুরু।তিনি লিখতে শুরু করেন বিভিন্ন বাংলা গান। আধুনিক প্রেমের গান,কাওয়ালি,শ্যামাসংগীত,ভজন,ঈদের গান,দেশাত্মবোধক, নাচের গান,ঝুমুর গান,আরবি সুরের বিভিন্ন গান ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। কবিতাও লিখতে শুরু করেন তখনই।বিভিন্ন আঙ্গিকের কবিতা সৃষ্টি হতে থাকলো। তালতলা লেনে থাকার সময়ে ১৯২২ সালে একদিন সারারাত জেগে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন একটি কবিতা।পাশে ঘুমোচ্ছিলেন সাথী মুজফফর আহমেদ। ভোরের বেলায় মুজফফর আহমেদের ঘুম ভাঙতেই কাজী নজরুল প্রথম মুজফফর আহমেদ কে সেই কবিতাটি পাঠ করে শোনান..সেই কবিতাটিই হোল বিখ্যাত কবিতা…”বল বীর,বল উন্নত মম শির…” এর সেই “বিদ্রোহী” কবিতা। যে কবিতা নজরুল শুনিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে,তাঁর বাড়িতে গিয়ে।রবীন্দ্রনাথ পুত্রসম কাজী নজরুলকে আশীর্বাদ করেছিলেন বুকে জড়িয়ে ধরে।

নজরুল দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা লেখার জন্য ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে বেশ কয়েকবার কারাবন্দী হয়েছেন।কলকাতার আলিপুর জেলে,হুগলির জেলে,বহরমপুর জেলে।

তবু আগুন ঝরানো গান কবিতা লিখে গেছেন কাজী নজরুল একের পর এক। তখনকার দিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যুক্ত বিপ্লবীদের কন্ঠে কন্ঠে ঘুরে ফিরে বেড়াতো কাজী নজরুলের গান,কবিতা।এমনকি চারন কবি মুকুন্দদাসও কাজী নজরুলের গুণগ্রাহী ছিলেন।গুণগ্রাহী ছিলেন দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পন্ডিত,নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু,দেশবন্ধু,বাংলার বিপ্লবীরা সকলেই। তিনি জাত-ধর্ম,সংকীর্ণতা একদম মানতেন না।নিজের জীবনেও তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।
তাই তিনি বিয়ে করেছিলেন প্রমীলা সেনগুপ্তকে।কিন্তু বিয়ের পরে কোনও রকমের ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠেনি।কাজী নজরুল তাঁর সন্তানদের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মহম্মদ যীশু(বড় ছেলে।যার ডাক নাম ছিল বুলবুল।অল্প বয়সে সে মারা যায়)।তারপরের ছেলের নাম রাখেন সব্যসাচী।কনিষ্ঠ সন্তানের নাম ছিল অনিরুদ্ধ। এমন কি নজরুলের পুত্রবধূদের নাম এবং তথাকথিত জাত-ধর্ম ছিল ভিন্ন,তবু সেই ব্যাপারে কোনো রকমের সমস্যার সংকীর্ণতা সেখানে ছিল না।সব্যসাচীর স্ত্রীর নাম ছিল উমা(মুখোপাধ্যায়) এবং অনিরুদ্ধর স্ত্রীর নাম ছিল কল্যানী।
গ্রামাফোন কোম্পানীতে তিনি যুক্ত ছিলেন।তিনি প্রায় ৮হাজার গান লিখেছিলেন। তবে তার বেশীরভাগ সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়,নষ্ট হয়ে যায়।৪হাজারের মতো গান সংকলিত করা আছে।

১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়ানের দিন রেডিও থেকে শোকযাত্রার ধারা বিবরনী দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। ১৯৪২ সালে নজরুল রেডিওতে ঘোষণা করতে করতে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন।সমস্ত স্মৃতিশক্তি চলে যায় নজরুলের। সে এক মর্মান্তিক অবস্থা। তার আগে ১৯৪০ সালে নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা দেবী কোমর থেকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তখন কাজী নজরুল ইন্টালী-শীললেনের কাছে ক্রিস্টোফার রোডে থাকতেন। অনেক চিকিৎসা করেও কোনও সুফল পাওয়া যায়নি। বিদ্রোহী কবি এক পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। সে এক করুন কাহিনী।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পাওয়ার পরে শেখ মুজিবুর রহমান কাজী নজরুল ইসলাম কে ঢাকায় নিয়ে যান। বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসাবে সম্মান জানানোর জন্য।সেখানে নজরুলের সাথে ছিলেন কাজী সব্যসাচীর স্ত্রী উমা কাজি,নাতনী খিলখিল কাজি,অনিন্দিতা কাজি(কাজী অনিরুদ্ধর মেয়ে)।

১৯৭৬ সালের ২৯ শে আগস্ট (বাংলায় ১২ই ভাদ্র,১৩৮৩) তারিখে সকাল বেলায় ঢাকাতেই কাজী নজরুল ইসলাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

এপার বাংলা ওপার বাংলার অবিস্মরণীয় অবিসংবাদিত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মহাপ্রয়ান দিবসের প্রাক্কালে আমাদের আন্তরিক প্রণাম রেখে গেলাম। কবির কথায়…”আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো,তবু আমারে দেব না ভুলিতে…”।
বাংলা এবং বাঙালী ভুলতে পারবে না কোনোদিন তার প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। এটাই চিরন্তন সত্য।

Related posts

আমাদের দেশ, আমাদের দ্বেষ-বিদ্বেষ এবং রবীন্দ্রনাথ

কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর, সে-দেহে তাহার কোন প্রমাণ ছিল না

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…