প্রথম পাতা প্রবন্ধ ১৩ মার্চ: স্মৃতি এবং বাঙালির দুই কবির চিরবিদায়!

১৩ মার্চ: স্মৃতি এবং বাঙালির দুই কবির চিরবিদায়!

406 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

বাংলা সাহিত্যে দুই কবি…কবি জসীমউদ্দিন এবং কবি দীনেশ দাস… আমাদের স্মৃতিতে বোধহয় আমরা তাঁদের মনেই রাখিনি। আজ এই দুই আপন কবির আগামীকাল (সোমবার) চির বিদায়ের দিনের প্রাক্কালে আমরা আসুন, একটু স্মৃতিচারণ করি।

কবি জসীমউদ্দিন

পুরো নাম ছিল মহোম্মদ জসীমউদ্দিন মোল্লা।১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারী তিনি ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে (এখন বাংলাদেশ) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা ছিলেন পেশায় শিক্ষক মহোম্মদ আনসারউদ্দিন মোল্লা,আর মায়ের নাম ছিল আমিনা খাতুন। জসীমউদ্দিন ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষে চলে আসেন কলকাতায়। এখান থেকে তিনি বি.এ (১৯২৯) এবং এম.এ.(১৯৩১) পাস করেন।

এরপরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন। তিনি কৈশোর থেকেই কবিতা,গল্প লিখতেন। তিনি দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে সংকলন করেছিলেন “পূর্ববঙ্গ গীতিকার ” সংকলন।

তিনি ভাটিয়ালি, জারিগান,মুর্শিদি গান,কবিতা,গল্প,উপন্যাস, ইত্যাদি লিখে গেছেন। তাঁর লেখা গানঃ” আমায় ডুবাইলি রে আমায় ভাসাইলি রে,অকুল দরিয়ার বুঝি কুল নাই রে…”,এই গানটি প্রখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দীন আহমেদ গেয়েছিলেন ভাটিয়ালি সুরে।আজও সেই গান বাঙালির অন্তরে অন্তরে বিরাজ করছে। জসীমউদ্দিন এর “নকশীকাঁথার মাঠ”(১৯২৯) “কবর”(১৯২৯), ” বাখালি”( ১৯৩০), ” বালুচর”(১৯৩০), ” ধানখেত”(১৯৩৩), “সোজন কাজিয়ার ঘাট” (১৯৩৩), “হাসু”(১৯৩৮), ” রূপবতী “(১৯৪৬)…..ইত্যাদি ইত্যাদি অসংখ্য কবিতা,গল্প,উপন্যাস লিখেগেছেন।তাঁর বিখ্যাত গানের মধ্যে.. “ও আমার গহীন গাঙের নাইয়া..”, “কাজল ভ্রমরা রে..”, ” নদীর কুল নাই,কিনার নাই,..” অন্যতম।

জসীমউদ্দিন এর “নকশীকাঁথার মাঠ” ইংরাজি ভাষায় অনুদিত হয়েছে…”দ্য ফিল্ড্ অব্ এমব্রাউডেড্ কুইলেট্” নামে।

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন কবি জসীমউদ্দিনের বিশেষ বন্ধু।

কবি জসীমউদ্দিন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুরষ্কারে সম্মানিত হয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের “ডি.লিট.”(১৯৬৯), “প্রেসিডেন্ট এওয়ার্ড”(১৯৫৮), বাংলাদেশ সরকারের “একুশে পদক” (১৯৭৬), “স্বাধীনতা দিবস” (১৯৭৮)..মরনোত্তর পুরস্কার, ইত্যাদি।

সুদুর লণ্ডনে পল্লীকবি জসীমউদ্দিন এর মরমি মর্মর মূর্তি স্থাপত্য আকারে বিরাজ করছে। কবি ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ এই জগৎ থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নেন। আমরা প্রণাম রেখে যাই কবি জসীমউদ্দিন এর চরণ ছুঁয়ে।

কবি দীনেশ দাস

তখন চলছে স্বাধীনতার আন্দোলন। স্বাধীনতাকামী মানুষ,শ্রমিক – কৃষক সাধারণ মানুষ সকলেই দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য আকুল,আন্দোলনের অংশীদার। ব্রিটিশ শাসকও বিপ্লবীদের ওপরে নামিয়ে এনেছিল অকথ্য অত্যাচার। সহযাত্রী বিপ্লবীদের তিনি যেন আহ্বান করে বলেছিলেন তাঁর কবিতায়…”বেয়নেট হোক যত ধারালো,কাস্তেটা শান দিও বন্ধু…”।৷ অর্থাৎ যতি অত্যাচার হোক,তৈরী থেকো বন্ধু….। বাংলা সাহিত্যের “কাস্তে কবি” নামে চির অমর হয়ে আছেন কবি দীনেশ দাস।

১৯১৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর কলকাতার আলিপুর চেতলা অঞ্চলে ৬৫ এফ, জয়নুদ্দিন মিস্ত্রি লেন,কলকাতা-২৭ এর বাড়িতে কবি দীনেশ দাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবার নাম ছিল হৃষিকেষ দাস,আর মায়ের নাম ছিল কাত্যায়নী দেবী। চেতলা বয়েজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯৩০)পাস করেন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আই.এ. পাস করেন (১৯৩২)সালে। এরপর কলেজে পড়ার সময়ে তিনি স্বাধীনতার আন্দোলনে বিপ্লবী পন্থায় যুক্ত হন,ফলে একটু দেরিতে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হন ১৯৩৮ সালে।

এরপর চা-বাগানে চাকরি করেন।তারপর ক্যালকাটা ন্যাশানাল ইন্সিওরেন্স(পরে এল.আই.সি.) তে কাজ করেন। ইউনিয়ন করার জন্য চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি হাওড়ার দেউলটিতে স্কুলে শিক্ষকতা করতে চলে যান। সবশেষে তিনি কলকাতার চেতলা বয়েজ স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন।

তাঁর লেখা কবিতা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যন্ত মন দিয়ে পড়তেন।৷ কাজী নজরুল ইসলামও কবি দীনেশ দাসের গুণগ্রাহী ছিলেন। কবি দীনেশ দাসের “কাস্তে” কবিতাটি তখনকার ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ (Banned) করে দিয়েছিল।

অসংখ্য কবিতা তিনি লিখেছেন। “কাস্তে”, ” নখ”, “প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা”, “শ্রাবনে”,ইত্যাদি ইত্যাদি…। কবি দীনেশ দাস বিভিন্ন সম্মান পেয়েছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ.. “উল্টোরথ পুরস্কার” (১৯৫৯),
“নজরুল পুরস্কার ” (১৯৮০), “রাম গেছে বনবাসে” কাব্যগ্রন্থের জন্য কবি দীনেশ দাস ” রবীন্দ্র পুরস্কার”-এ সম্মানিত হয়েছিলেন ১৯৮২ সালে।

১৯৮৫ সালের ১৩ মার্চ কাস্তে কবি দীনেশ দাস বনগাঁর গোপালপুরে পৈতৃক বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আমরা বিনম্র শ্রদ্ধায় কবি দীনেশ দাসের চরণ ছুঁয়ে যাই।

স্মৃতি স্মরণ থেকে রইল এই বিস্মৃত দুই কবির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.