‘আমি বনফুল গো’ এবং কিংবদন্তী শ্রীমতী কানন দেবী

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

প্রথা অনুযায়ী যে কোন ব্যক্তির পরিচয়ের সুত্রপাত হয় জন্ম থেকে কিন্তু,এখানে প্রকৃতির কোলে যেন আপন খেয়ালই জন্ম নিয়েছিলেন একটি শিশু। সালটা ছিল ১৯১৪,মতান্তরে ১৯১৬। তারিখটা ২২ শে এপ্রিল।

সে যাইহোক, পিতা -মাতা হীন সেই ছোট্ট শিশুটিকে বুকে তুলে নিয়েছিলেন সন্তান স্নেহে সন্তানহীন এক দম্পতি।হাওড়ার রতন চন্দ্র দাস এবং তার স্ত্রী রাজবালা দাস। থাকতেন হাওড়ায় ঘোলাডাঙ্গা নামে একটি জায়গাতে। সেই শিশুটি তাদেরই মা-বাবা বলেই চিনতো,জানতো,এবং ডাকতো।

সেই শিশুটিই পরবর্তী সময়ে বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমা ও সঙ্গীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হয়ে জগৎ বিখ্যাত হয়ে লিখেছিলেন তাঁর  আত্মজীবনের কথা ‘সবারে আমি নমি’। সেই বইতেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর বাবা মা হিসাবে পালিত এই পিতা মাতার কথা আর তার সাথে সেই শৈশবেই একরাশ দারিদ্র্যতার সাথে লড়াই করার কাহিনী।

হ্যাঁ, ইনিই হলেন বাংলা ও ভারতীয় সিনেমা ও সঙ্গীত জগতের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র শ্রীমতী কানন বালা দেবী,তথা শ্রীমতী কানন দেবী।

বেঁচে থাকার জন্যেই অনেক ছোট্ট বেলা থেকে কানন বালা প্রথমে বিভিন্ন বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন,পরে সেই শৈশবেই তিনি অভিনয়ের জগতে কাজ করতে শুরু করেন। তাঁর অভিনয়ের প্রাঞ্জলতা, দক্ষতা,ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যায় সফলতার পথে।

কানন দেবী অভিনয় করেছেন কুন্দললাল সায়গল,প্রমথেশ বড়ুয়া,শিশির ভাদুড়ি, অহীন্দ্র চৌধুরী,পাহাড়ি সান্যাল,পঙ্কজ কুমার মল্লিক, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তম কুমার,সুচিত্রা সেন,প্রমুখদের সঙ্গে বিভিন্ন ছবিতে।

তিনিই প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত নিজের গলায় গেয়েছিলেন সিনেমাতে নিজে অভিনয়ের সাথে সাথে।তাছাড়াও তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন অনেকগুলি।তিনি এই গান শিখেছিলেন প্রথম জীবনে,ছোট বেলায় পাড়ার এক অখ্যাত “ভোলাদা”-র কাছে,আর  আশ্চর্যময়ী দেবীর কাছে।পরে,ওস্তাদ আল্লারাখা,অনাদি ঘোষ দস্তিদার,পঙ্কজ কুমার মল্লিক,রাইচাদ বড়াল,আখতারী বাঈ,ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র,দিলীপ কুমার রায়(কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ছেলে), কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখদের কাছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কানন দেবীর রেকর্ডে কবিগুরুর গান শুনে খুব আনন্দিত হয়েছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই তাঁকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে গান শোনানোর অনুরোধ করেছিলেন।কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়,কবিগুরু তারপরই চিরবিদায় নিয়েছিলেন। কবিগুরুকে গান শোনাতে না পারার দুঃখ কানন দেবীর আজীবনের দুঃখ ছিল।

১৯২৬ সালে তিনি প্রথম অভিনয় করেন ম্যাডার্ন কোম্পানির “জয়দেব” নামে এক নির্বাক সিনেমাতে।

এরপর তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের এক কিংবদন্তিতে পরিণত হ’ন। অনেক বাংলা সিনেমাতে তিনি স্মরণীয় অভিনয় করেছিলেন। গানও করেন। পরে তিনি শ্রীমতী পিকচার্স নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মান কোম্পানী তৈরী করেন।

তিনি ভারত সরকারের পদ্মশ্রী  (১৯৬৮)সম্মানে সম্মানিত হন। দাদাসাহেব ফালকে১৯৭৬) এবং সিনে সেন্ট্রাল-এর হীরালাল সেন পুরস্কার(১৯৯০), ইন্দিরা গান্ধী স্মৃতি পুরস্কার(১৯৯১)- এ তিনি পুরস্কৃত হন।

২০১১ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী  ভারত সরকারের ডাক বিভাগ থেকে কানন দেবীর নামে একটি ডাক টিকিট প্রকাশ করা হয়।

আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গনে সুবিশাল কীর্তি প্রতিষ্ঠা করে কানন দেবী ১৯৯২ সালের ১৭ই জুলাই,অর্থাৎ আজকের দিনে আমাদের কাছ থেকে চির বিদায় নেন ৭২ বছর বয়সে।

Related posts

আমাদের দেশ, আমাদের দ্বেষ-বিদ্বেষ এবং রবীন্দ্রনাথ

কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর, সে-দেহে তাহার কোন প্রমাণ ছিল না

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…