আমরা কি চেষ্টা করেছি তাঁকে জানতে, বুঝতে? আসুন, ভাবি একবার

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

১৬২ তম জন্মতিথি পার হয়ে গেল স্বামী বিবেকানন্দের। আমাদের গড্ডলিকায় ব্যস্ত আমরা, জানতেই পারলাম না। খেয়ালই করলাম না।

মাঝে মাঝে মনে হয়, যে,আজও স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শের যথাযথ সম্মান, মূল্যায়ন আদৌ আমরা করতে পেরেছি কি?
বোধহয় না। আমরা স্বামী বিবেকানন্দকে গেরুয়া পরিয়ে মঠের মধ্যে বন্দী করে রাখলাম। আর আমাদের যে যার মস্তিষ্কের ধ্যান ধারণা অনুযায়ী তাঁকে নিয়ে নিজেদের অক্ষমতা সত্ত্বেও মন্তব্য করে গেলাম।তারপর এক সময়ে খেই হারিয়ে ফেলে নিজেরাই নিজেদের কাছে নিকৃষ্ট কীটস্য কীট হিসেবে প্রতিপন্ন হয়ে রইলাম। তিনি জীবিত থাকাকালীন আমাদের সেই সময়ের বাঙালীদের অধিকাংশ যত দূর নীচে নেমে অপমান,অশ্রদ্ধা করা যায়,তাঁকে করেছিলেন,সেসব ইতিহাসে লেখা আছে। আর তারপর, স্বামী বিবেকানন্দকে এবং তাঁর অত্যন্ত প্রগতিশীল,ভারতবর্ষের জাতীয়তাবোধের উদ্দীপিত,সমাজবাদী ভাবনা চিন্তা আদর্শকে আমাদের ডান -বাম সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি তাদের ভাবনার সীমাবদ্ধতা দিয়ে তাঁকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে নিজেদের অপরিণামদর্শীতা, অক্ষমতা, অযোগ্যতাকে জনসমক্ষে নিয়ে এসেছে,সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে,আর এগুলি তারা করেছে শুধু নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য।তাই স্বামী বিবেকানন্দ আবদ্ধ রইলেন মঠে,জন্মদিনে যুবদিবসের উদযাপনে,আর হিন্দু ধর্মের একজন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী হিসাবে।

এই প্রতিবেদনে সেই বিষয়টিকে নস্যাৎ করে স্বামী বিবেকানন্দের অনির্বচনীয় বিশালত্ত্ব নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাতের প্রয়াস রেখে গেলাম।

আচ্ছা, একবারও আমরা ভেবে দেখেছি কি যে,দীর্ঘ হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে বিভিন্ন বৈদেশিক আক্রমনে জর্জরিত,ভারতবর্ষ নামক একটি বিশাল ভুখন্ডের একদিকে আভ্যন্তরীণ সামাজিক,রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক বিভেদে বশীভূত ,এরসাথে অপরদিকে সামাজিক স্তরে শিক্ষাহীনতা,উন্নয়নহীনতা, ঔদার্যহীনতা, অস্পৃশ্যতা,ধর্মীয় নানান বিধিনিষেধের অত্যাচার,জাত-বেজাতের লড়াই,অন্যায় অবিচার,নানান কুসংস্কারে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ১০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে পরাধীন থাকা একটা জাতি,একটা দেশ ছিল সেই সময়ের বাস্তবতায়।সেই সময়ে যার শিরদাঁড়া সম্পূর্ণ দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেই পরাধীনতার মানসিকতায় যে জাতি তখন নিজেদের দাসত্বের আজ্ঞাবাহক বশংবদতায় বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পদলেহনে নিমজ্জিত,সেই জাতটাকে,সেই দেশের মানুষকে প্রথম যিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বৈপ্লবিক বোধের জন্ম দিয়েছিলেন,অসাড়তার নিমজ্জিত অবস্থা থেকে জাগতে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তিনি আর কেউ নন.., তিনি স্বামী বিবেকানন্দ।

তিনি তো পারতেন,এদেশের মানুষকে নিয়ে সনাতনী ঐতিহ্যের ধ্বজাধারী হয়ে গুরুগিরি করতে। সে পথ তো অবারিত ছিল তাঁর কাছে। কিন্তু না,তিনি তা করেননি।তিনি সারা ভারতবর্ষের মানুষকে জানতে,চিনতে,বুঝতে,অন্তর দিয়ে তাকে অনুভব করতে ৬/৭বছর ধরে পরিব্রাজক হয়ে ঘুরলেন সারা দেশের আনাচে কানাচে।না কোন ধর্মীয়স্থানে নয়,রইলেন,পথে,রেল স্টশনে,সাধারণ মানুষের ঝুপড়িতে,পাহাড়ে,সাগরের বুকে থাকা অগম্য শিলাখন্ডের উপরে,আবার কখনো কখনো তাঁকে রাস্তা থেকে সসম্মানে নিয়ে যাওয়া দেশীয় কোন রাজার অতিথি হিসাবে।

তাইতো তিনি যখন বিশ্বজয় করে আমেরিকায়,তখনও তাঁর মনের মণিকোঠায় স্মৃতিতে,তাঁর চোখে ভাসছে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ অসহায়,নিরন্ন,দুঃখী,দুঃস্থ তাঁর নিজের দেশবাসীর, ভারতবাসীর মুখ,তাদের জীবনের যাবতীয় বিপন্নতা।

তাইতো তিনি ধর্মমহাসম্মেলনের সেই বিশাল মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতে পেরেছিলেন ভারতবর্ষের আশু প্রয়োজন কোনও ধর্ম নয়,ভারতের কোটি কোটি আর্ত নরনারী অন্ন চায়–“ক্ষুধার্ত মানুষকে ধর্মের কথা শোনানো বা দর্শনশাস্ত্র শেখানো, তাহাকে অপমান করা হয়।”

তিনিই প্রথম বুঝেছিলেন,যে দারিদ্র্যতা,আচারসর্বস্ব, বিভেদ,হুজুগ,আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতের সমাজে আগে দরকার রুটি-রুজির সংস্থান,সামাজিক সমানাধিকার। ধর্মের ফন্দি -ফিকির নয়।মন্দির মসজিদ গুরুদ্বারা,গীর্জা নয়। তিনি তীব্র সমালোচনা করে লিখেছিলেন –“আমাদের পুস্তকে মহাসাম্যবাদ আছে,কিন্তু আমাদের কার্যে মহাভেদবুদ্ধি।”

আজও আমার আপনার ভারতবর্ষে উঁচুজাতের এলাকার নলকূপ থেকে পিপাসার জল নেওয়ার অপরাধে অন্ত্যজ নিরিহ অসহায় মানুষকে পিটিয়ে মারা হয়,আজও অন্য জাতের বা ধর্মের নারীকে বেমালুম বেইজ্জত করে তার জিভ কেটে নেওয়া হয়,বা প্রশাসনের উপস্থিতিতে তার দেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয় রাতের অন্ধকারে।আজও ভিন্ন জাতের ধর্মের নারী ধর্ষকদের আড়াল করার অপচেষ্টা করা হয় শাসকের দ্বারা,সেই অপরাধীকে বা অপরাধীদের বিচার থেকে (বিচারকের মতামত অনুযায়ী কাগুজে তথ্য প্রমানের কমজোরিতার জন্য ) বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়। আজও সামাজিকভাবে সব স্তরেই সবক্ষেত্রেই অসাম্য,অন্যায়,স্বজনপোষণ,সাম্প্রদায়িকতার বিষ রয়ে গেছে।বরং তার প্রতি সরকারি সীলমোহর লাগানো হচ্ছে কিছু কিছু ঘটনায়। এই যখন পরিস্থিতি, তখন আমরা শুনতে পাই, ১২৫/৩০ বছরেরও আগে স্বামী বিবেকানন্দের সেই বলিষ্ঠ উচ্চারণ –” আমরা এখন বৈদান্তিকও নই,পৌরাণিকও নই,তান্ত্রিকও নই,সাত্ত্বিক-তাত্ত্বিকও নই,দেশপ্রেমিকও নই; আমরা এখন ‘ছুঁৎমার্গী’, আমাদের ধর্ম এখন রান্নাঘরে,ভাতের হাঁড়িতে,বদনা-গাড়ুতে, কলতলায়,পুকুরঘাটে,পুকুরপাড়ে…আর ধর্মমত– ‘আমায় ছুঁয়ো না,ছুঁয়ো না,আমি মহাপবিত্র!’…. ” প্রাসঙ্গিকভাবেই এসে যায় সেই অমোঘ বাণী–” হে বীর সাহস অবলম্বন করো,সদর্পে ডাকিয়া বলো, মুর্খ দরিদ্র ভারতবাসী আমার ভাই,আমার বোন…”।

স্বামী বিবেকানন্দের নজরে পড়েছিল,যে দেশের সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য বা মহামারি রুখতে টাকাপয়সা জোটেনা,সেই দেশে মোটা টাকার ধর্মব্যবসা বেশ রমরমিয়ে চলে। ঘৃনায় তিনি তাঁর গুরুভাইদের চিঠিতে লিখছেন–” কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে কাশী বৃন্দাবনের ঠাকুর ঘরের,মসজিদের,গুরুদ্বারের দরজা খুলছে আর পড়ছে। এই ঠাকুর কাপড় ছাড়ছেন, তো এই ঠাকুর ভাত খাচ্ছেন,…এদিকে জলজ্যান্ত ঠাকুর অন্ন বিনা,বিদ্যা বিনা মরে যাচ্ছে।”

তিনি ধর্মের ধ্বজাধারী নন,তিনি কোনও “বাবা” নন,তিনি শুধু গেরুয়াতে,মঠে সীমাবদ্ধ নন,তিনি ব্রাত্যজনের সখা,এই দেশে,এই বিশ্বে,মানুষকে, জীবনকে শিবজ্ঞানে সেবা করার বীজমন্ত্রের উদ্গাতা। সারসত্য তিনিই বলেছিলেন –“যদি একজনেরও মনে এই সংসার নরককুন্ডের মধ্যে একদিনও একটু আনন্দ ও শান্তি দেওয়া যায়,সেইটুকুই সত্য…বাকি সব ঘোড়ার ডিম।”

তিনি এই দেশকে মাটির শিকড় থেকে ভালো বেসেছিলেন।…”দেশের মানুষকে তিনি ভালোবেসেছিলেন তাঁর শয়নে, স্বপনে, জাগরণে..” (ভগিনী নিবেদিতা)। “এই দেশের প্রতিটি বিষয়ে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ইতিবাচক। তাঁকে জানলে,চিনলে,তাঁর বাণী পড়লে তুমি জানতে পারবে ভারতবর্ষকে…”। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

স্বামী বিবেকানন্দই প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন–” নতুন ভারত বেরুক, বেরুক চাষার লাঙ্গল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে,জেলে-মাল্লা–মুচি-মেথরের ঝুপড়ীর মধ্য থেকে,বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে,বেরুক কারখানা থেকে,হাট থেকে,বাজার থেকে,বেরুক জঙ্গল-পাহাড়-পর্ব্বত থেকে..”।

ভাবা যায় আজ থেকে ১২৫/১৩০ বছর আগে তিনি বলেছিলেন–” খেতে বসে আমাদের মনে রাখতে হবে,থালায় যে খাদ্য পরিবেশন করা হয়েছে,সেটা সাধারণ মানুষের পরিশ্রমের ফল।বস্ত্র পরিধানের সিময়ে অগনিত অজানা,অচেনা মানুষের কথা মনে রাখতে হবে,যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই বস্ত্র আমাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। মনেমনে তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে,কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে তাদের কল্যানের জন্য অবশ্যই প্রার্থনা করতে হবে আমাদের।”
“দৈনন্দিন ব্যবহারযোগ্য জিনিষের প্রতি আমাদের এবং যারা সেইসব নিত্যদিন উৎপাদন করছেন,তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিৎ। সম্ভব হলে,তাদের কাছে গিয়ে বা কিছুদিন তাদের সঙ্গে থেকে দেখতে হবে কত কষ্টের মধ্যে দিয়ে তাদের জীবনযাপন করতে হয়।তবেই বুঝতে পারবো জিনিষের অপচয় করা কতখানি অন্যায়। আর সেইসব মানুষজন আমাদের কাছে ভগবানের তুল্য।তাই তাদের সেবা করাই হবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। “

তিনি আরও লিখছেন– “যতদিন ভারতের কোটি কোটি লোক দারিদ্র্যতার ও অজ্ঞানান্ধকারে ডুবে রয়েছে,ততদিন তাদের পয়সায় শিক্ষিত অথচ যারা তাদের দিকে ফিরেও চেয়ে দ্যাখেনা,–এরূপ প্রত্যেক ব্যক্তিকে আমি দেশদ্রোহী, সমাজদ্রোহী,অপরাধী,ঘৃন্য বলে মনে করি।”

স্বামী বিবেকানন্দ স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই ভারতবর্ষের, যেখানে মানুষকে অন্ন দিয়ে,বস্ত্র দিয়ে,শিক্ষা দিয়ে,কাজ দিয়ে,স্বাস্থ্য দিয়ে,সুরক্ষা দিয়ে আগলে রাখবে দেশের পরিচালকরা।জাত-ধর্ম, জাত-পাত এর সংকীর্ণতা দিয়ে নয়।

ধর্ম নয়,আগে মানুষ।

দুদিন আগে ছিল স্বামী বিবেকানন্দের শুভ পবিত্র জন্মতিথি..।
রেখে গেলাম তাঁর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা এবং প্রণতি।

(তথ্য সুত্র:- স্বামী বিবেকানন্দ /বাণী ও রচনা/উদ্বোধন / এবং স্বামী বিবেকানন্দ :পত্রাবলী /উদ্বোধন //)

Related posts

আমাদের দেশ, আমাদের দ্বেষ-বিদ্বেষ এবং রবীন্দ্রনাথ

কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর, সে-দেহে তাহার কোন প্রমাণ ছিল না

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…