১৯৯২-এর ইউরো কাপ ফুটবল সেদিন কেঁদেছিল

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

সে প্রায় আজ থেকে ৩০ বছর আগের কথা। ১৯৯২-এর  ফুটবলের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের (ইউরো কাপ) খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সুইডেনে।

সেই বছর যুদ্ধ বিধ্বস্ত অন্যতম  ইউরোপের ফুটবল টিম যুগোশ্লোভাকিয়া যোগ্যতা অর্জন করলেও শেষ অবধি খেলায় অংশ নিতে পারেনি বিপর্যয়গ্রস্ত যুগোশ্লোভাকিয়া দেশ। খেলা শুরু হতে তখন মাত্র দশ দিন বাকি, টুর্নামেন্টের আয়োজক উয়েফা ঘোষনা করলো যে যুগোশ্লোভাকিয়ার বদলে ডেনমার্ক খেলায় অংশ নেবে। ডেনমার্ক-এর সেভাবে কোন প্রস্তুতিই ছিল না। তারা জানতই না যে তারা খেলবে। এদিকে খেলায় অংশ নেওয়া ইউরোপের অতি শক্তিশালী দল হিসাবে সুইডেন,জার্মান, ফ্রান্স,নেদারল্যান্ডস, ইটালি,ইংল্যান্ড,পর্তুগাল,প্রমুখ টিমগুলি জোর প্রস্তুতি নিয়েছিল।

যাইহোক,ডেনমার্ক যেনতেন প্রকারেন প্রস্তুতি নিয়ে ইউরো কাপ খেলতে নামল।

প্রথম ম্যাচে তারা ইংল্যান্ডের সঙ্গে হারতে হারতে ড্র করলো। দ্বিতীয় ম্যাচে সুইডেনের কাছে হেরে গেল।

সমালোচকরা সবাই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলতে লাগলো যে ডেনমার্ক সরাসরি যোগ্যতা অর্জন না করেই

” back door entry”  নিয়ে খেলছে, তাই হেরে ভুত হয়ে যাবে। এর থেকে ভালো আর কি হবে? প্রায় সকলেই ধরে নিয়েছিলেন যে গ্রুপের শেষ ম্যাচে শক্তিশালী ফ্রান্সের কাছে গো-হারান হেরে গিয়ে ডেনমার্ক বিদায় নেবে।

এদিকে এক দুঃসংবাদ এলো ডেনমার্কের কোচ মোলার নিয়েলসনের কাছে, যে টীমের অন্যতম খেলোয়াড় কিম ভিলফোর্ট- এর সাত বছরের ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে ব্লাড ক্যান্সারে (লিউকোমিয়া) আক্রান্ত হয়ে খুব সঙ্কটজনক অবস্থাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এই খবর শোনা মাত্রই কিম ভিলফোর্ট তার সতীর্থদের (হেনরিক লারসেন,পিটার স্কিমিচিয়েল,লারস এলস্ট্রুপ,প্রমুখ) ছেড়ে তার স্বদেশের হাসপাতালে ভর্তি থাকা ছোট্ট সোনা মেয়ের কাছে ফিরে গেলেন।

কিম ভিলফোর্টের  সন্তানের ব্লাড-ক্যান্সারে মারাত্মক অসুস্থ হওয়া এবং তার এই ডেনমার্কে ফিরে যাওয়ায় তখন সবাই ভেবে নিয়েছিল যে ডেনিশরা এবারে ইউরো কাপ ফুটবলের খেলা থেকে বিদায় নেবেই।

কিন্তু,তারপরই ঘটেছিল সেই অঘটন।

বাবা,তুমি যাও, মাঠে নামো দেশের হয়ে,খেলো সেই খেলা,যা এনে দেবে ফুটবলে ইউরোপের সেরা সম্মান। আমি দেখবো তোমার সেই খেলা। টিভিতে।

সেই বারের ইউরো কাপে ডেনমার্ক এর ড্যানিশ ডায়নামাইট বিস্ফোরন ঘটল্। কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী ফুটবল দল ফ্রান্সকে হারিয়ে তারা সেমি-ফাইনালে উঠেছিল ডেনমার্ক।

এদিকে কিম তখন হাসপাতালে মেয়ের শয্যার পাশে। মেয়ে তার শরীরের কষ্ট নিয়েও খেলা দেখেছিল, ক্যান্সারে আক্রান্ত মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে লড়তে কিম ভিলফোর্টের সাত বছরের মেয়ে লাইন ভিলফোর্ট। বাবার হাতের মুঠোয় তার হাত দুটি রেখে,আর তার চোখ দুটি ছিল টিভির পর্দায়।

বাবার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ছোট্ট মেয়েটি সেদিন তার বাবাকে বলেছিল, যে তার বাবা যেন ফিরে যায় সুইডেনে। ইউরো কাপের খেলার মাঠে। কারণ তাদের দেশ ডেনমার্ককে সেমিফাইনালে খেলতে হবে আরও শক্তিশালী ইউরোপের অন্যতম ফুটবল দল নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে। আর তার বাবা যেন ফাইনালে ইউরো কাপ জিতে দেশে আনতে পারে, তাই সেই ছোট্ট সোনা মেয়ের একান্ত আবদার আর ইচ্ছের কথা সে তার বাবাকে বলেছিল সেদিন, ” বাবা,তুমি খেলতে যাও,জিতে কাপ নিয়ে এসো”।  তখন সে শুয়ে আছে ক্যান্সার হাসপাতালের শয্যাতে,  কচি হাতে তার স্যালাইন আর অগুন্তি ইঞ্জেকশন দেবার চ্যানেল লাগানো, কেমোথেরাপির জন্যে তার মাথার সোনালী ঝাঁকড়া চুলগুলি আর নেই। মাথায় তার সার্জিক্যাল শিরোস্ত্রাণ। কিন্তু, তার সব যন্ত্রনা,সব কষ্ট সহ্য করেও সে তার দু’চোখে স্বপ্ন দেখছে তার বাবা জিতিয়ে আনবে তাদের দেশের জন্যে ইউরো কাপ ফাইনালের জয়ী দল হয়ে সেই শিল্ড। যেটা সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বারবার টিভিতে দেখেছে। সে দেখতে চায় তার বাবা একাই একশ হয়ে তার জন্যে মাঠে এমন খেলা খেলবে, যে সারা ইউরোপ, সারা দুনিয়ার তাক লেগে যাবে।

তাই সেই সাত বছরের মেয়ে লায়েন ভিলফোর্ট-এর আবদার, ” বাবা,তুমি যাও, মাঠে নামো দেশের হয়ে,খেলো সেই খেলা,যা এনে দেবে ফুটবলে ইউরোপের সেরা সম্মান। আমি দেখবো তোমার সেই খেলা। টিভিতে”।

না,সেদিন কিম তার সন্তানের সেই আবদার ফেলতে পারেনি। তাই ফিরে গিয়েছিল খেলার মাঠে। কিন্তু তার সেই যাওয়ায় ছিল তার সেই ছোট্ট আদরের মেয়ের জন্য বুকভরা একরাশ দুশ্চিন্তা,ব্যাথা-বেদনা আর আশঙ্কা।আর ছিল কিমের দু-চোখ ভরা সকলের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা কান্না। বিশেষ করে মেয়ে লায়েন-এর কাছ থেকে।

কিম খেলতেন ফুটবল মাঠে মিড-ফিল্ডার পজিশনে,মাঝে মাঝে উঠে যেতেন ফরোয়ার্ডিংয়েও।

কিম ফিরে আসতেই ডেনমার্কের অন্যান্য সহ-খেলোয়াররা আরও অনেক অনেক বেশী উৎসাহিত হোল। তারা খবর নিল কিমের মেয়ে তাদের আদরের ছোট্টসোনা লায়েন ভিলফোর্টের। তারা যখন শুনলো যে সেই ছোট্ট মেয়েটিই তার ক্যান্সারের যন্ত্রনা হাসিমুখে সহ্য করেও তার বাবাকে দেশের জন্যে খেলতে পাঠিয়েছে,আর বলেছে দেশকে চ্যাম্পিয়ন করতে। তখন সেই কথা শুনে লারসেন-স্কিমিচেল-ব্রায়ান, এলস্ট্রুপ-হেনরি প্রমুখ ডেনমার্কের খেলোয়ারদের চোখ ভরা অশ্রু আর মনের মধ্যে জন্ম নিচ্ছিল এক অদম্য-আপোষহীন জেদ এবং আত্ম-অঙ্গীকার, যা সমস্ত ডেনমার্ক দলটাকে মরনপণ লড়াইতে লড়তে এক ইস্পাত-কঠিন মানসিক দৃঢ়তা তৈরী করেছিল সেদিন।

তারপর সে এক ইতিহাস। আদরের নয়নমণি সাত বছরের মেয়ে লায়েন ভিলফোর্ট ডেনমার্কের সেন্ট্রাল ক্যান্সার রিসার্চ মেডিকেল ইন্সটিটিউট এ্যান্ড হসপিটালে মৃত্যুর সঙ্গে অসম লড়াই লড়ছে,ডাক্তার,সিস্টাররা তাকে সারাক্ষণ ঘিরে রয়েছে,তাদের ছলোচলো চোখগুলি তারা ছোট্ট মেয়েটির চোখের আড়ালে গিয়ে মুছে নিচ্ছেন, মেয়ের মা রিখি ভিলফোর্ট অষ্টপ্রহর বসে আছেন মেয়ের কাছে,তার বুকের তলায় গুমরে গুমরে উঠছে কান্না।

আর অন্যদিকে খেলার মাঠে মেয়ের বাবা কিম ভিলফোর্ট তার সহ-খেলোয়ারদের সঙ্গে নিয়ে,তাদের উৎসাহ দিয়ে অনুপ্রানিত করে চলেছেন খেলায় জান-প্রান দিয়ে লড়াই করে জেতার জন্যে। সেই সব দৃশ্য হাসপাতালের বেডে কখনো শুয়ে শুয়ে,কখনো বসে দেখছে আর হাততালি দিচ্ছে সকলের নজরকাড়া সেই ছোট্ট মেয়েটি।

ডেনমার্ক – নেদারল্যান্ডস এর খেলায় ম্যাচ গড়ালো টাই-ব্রেকার অবধি। টাইব্রেকারে প্রবল চাপের মধ্যে থেকেও ভিলফোর্ট গোল করলেন। ডেনিশরা হেভিওয়েট  নেদারল্যান্ডস-কে হারিয়ে ইউরো কাপ ফাইনালে উঠল। সেই খেলায় ডেনমার্কের সমস্ত দলটাই যেন সেদিন উজাড় করে দিয়েছিল নিজেদের,তাদের মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছিল সারাক্ষণ ক্যান্সার রোগাক্রান্ত সাত বছরের সেই মেয়েটির মুখখানি।লায়েন ভিলফোর্টের মুখ।

খেলায় জয় হোল, কিন্তু কেউ সেই অবিশ্বাস্য জয় সেলিব্রেট করতে পারেনি। বাবা কিম তো নয়ই। তখন তাদের মনটা পুড়ে যাচ্ছিল ব্যাথা-বেদনায়। অসহায় বাবা কিম  আবার ফিরে গেল মৃতপ্রায় মেয়ের কাছে।

দলের সবাই চিন্তায় পড়লেন,তাহলে কি অভিজ্ঞ এবং দলকে উদ্দিপিত করার মূল কারিগর ভিলফোর্ট-কে ছাড়াই ডেনমার্ক-কে খেলতে হবে ফাইনালে তৎকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মান দলের বিরুদ্ধে?

ভিলফোর্টের তখন খিদে-তেষ্টা-ঘুম। এসব কিছুই নেই,শুধু অসুস্থ মেয়ের জন্য চিন্তা। হাসপাতালে মেয়ের বিছানার পাশে সারাদিন-সারারাত বসে আছেন। মেয়ের বিষণ্ণ-এক চিলতে হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন সারাক্ষণ। এক সময়ে মেয়ে বলল, “বাবা খেলতে যাবে তো? যাও বাবা,তুমি খেলতে যাও। আমি দেখবো সেই খেলা। দেখো তোমরাই জিতবে। হারাতেই হবে বিপক্ষকে”।তখন বাবার হাতের মুঠোয় ছোট্ট মেয়েটির হাত।

বাবা মেয়ের কথা সেদিন ফেলতে পারেননি। চোখের জল মুছতে মুছতে ২৯ বছরের  কিম ভিলফোর্ট ডেনমার্কের ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো ম্যাচ,ইউরো কাপের ফাইনালে জার্মান-এর শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে খেলতে নামলেন।

ফাইনালে ভিলফোর্টের খেলা দেখে সেদিন সারা ফুটবল দুনিয়া চমকে উঠেছিল। তিনি সারা মাঠে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সেদিন একাই একশো হয়ে। তিনি যেন তাঁর সর্বস্ব পণ করে সেদিন মাঠে নেমেছিলেন। অপরাজেয়,অদম্য ভিলফোর্টকে দেখে সেদিন ডেনমার্কের বাকি দশজন ফুটবলারের শরীরী ভাষা এক আপোষহীন দৃঢ়তায় পাল্টে গিয়েছিল। খেলায় এক সময়ে ডেনমার্ক জার্মানদের থেকে ১-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল। সেই এক গোল শোধ করার জন্য জার্মান মরিয়া হয়ে উঠেছিল।তীব্র আক্রমণে ডেনমার্ক-ও পিছিয়ে ছিল না।

তারপর এলো সেই মূহূর্তের খেলা। খেলার তখন আর শেষ আট মিনিট বাকি। দারুণ খেলে বিপক্ষের প্রায় সাতজন প্লেয়ারকে ডিবলিং, ডচ্ করে ভিলফোর্ট চমৎকার একটি গোল করে ডেনমার্কের ফলাফল ২-০ করে দিল। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি কে হারিয়ে ডেনমার্ক হোল ইউরো কাপ চ্যাম্পিয়ন হোয়েছিল।

সেদিন ক্যান্সার হওয়া সাত বছরের ছোট্ট লায়েন-এর বাবাকে নিয়ে যে আবেগ আর উচ্ছ্বাস ডেনমার্কের সমস্ত প্লেয়ার,সমর্থকদের হয়েছিল,তার প্রতিফলন জার্মান সমর্থকদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছোট্ট সাত বছরের লায়েন ভিলফোর্ট সেই ফাইনাল খেলা দেখেছিল, দেখেছিল তার বাবার আর ডেনমার্ক দলের বাকি সকলের সেই অভূতপূর্ব ৯০ মিনিটের খেলার প্রতিটি মূহূর্তগুলি সারা শরীরের সমস্ত কষ্ট-যন্ত্রনাকে উপেক্ষা করে।

ডেনমার্কের দেশবাসী,ফুটবল দলের সকলে আর ভিলফোর্ট এই ইউরো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দ উপভোগ করতে পারেননি। কারণ, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কয়েকদিন পরেই লায়েন মারা যায়।

তবু দুর্দান্ত লড়াই করার যে আত্মবিশ্বাস,যা লায়েনের অনুপ্রেরনাতেই অর্জন করেছিল সেদিনের ডেনমার্ক দল,তাই দিয়েই পরের তিন বছরের মধ্যেই তারা ১৯৯৫ সালে ফিফা কনফেডারেশন কাপও জিতে নেয়।

কিম ভিলফোর্ট ২০১৪ সালে ডেনমার্কের শতাব্দী সেরা “Danish Superleague Player of the Century…” অর্থাৎ ডেনমার্কের বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফুটবলারের সম্মান পেয়েছিলেন।

তিনি সমস্ত সম্মানগুলিই, পদকগুলি তাঁর সেই কন্যা লায়েন ভিলফোর্ট-কে উৎসর্গ করেন।

সারা জীবন বাবার মনের সবটুকু জুড়ে রয়ে গেছে আজ থেকে ৩০ বছর আগেকার সেই মরমি অশ্রুসিক্ত কাহিনিখানি।

আজও ইউরো কাপের খেলায় হয়তো বা পুরানো দিনের কেউ কেউ স্মরণ করেন একান্তে একান্তভাবে সেই কথাগুলি,” বাবা তুমি খেলতে যাও দেশের জন্যে। আর চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরে এসো আমার কাছে,আমি অপেক্ষা করবো। ততক্ষণ। “

কখন যেন চোখগুলি ভিজে যায়। কষ্টের,মনখারাপ করা দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ে বোধহয়। মুছে নেয় চোখ সবার আড়ালে।

Related posts

১৯শে মে বাঙালি ও বাঙলা ভাষার এক ইতিহাস

আমাদের দেশ, আমাদের দ্বেষ-বিদ্বেষ এবং রবীন্দ্রনাথ

কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর, সে-দেহে তাহার কোন প্রমাণ ছিল না