আজ সেই দিন এবং মহানায়ক

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

সারাটা জীবনই লড়াই ছিল যেন তাঁর নিত্য সঙ্গী।

খুবই গরীব ঘরের মানুষ ছিলেন। বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় এবং মা চপলা দেবীর সংসারে ভাই বোন মিলিয়ে সাত জন। ভবানীপুরের গিরিশ মুখার্জি রোডের একটি মাত্র ঘরে সবাই মিলে থাকা। আর তিনি তো ছিলেন বড়ো ছেলে।ফলে দায়িত্ব বেশী। প্রথমে ভবানীপুরের সাউথ সুবার্বান স্কুলের পড়া শেষ করেন,পরে কলেজে ভর্তি হয়েও পড়া শেষ না করেই অভাবের সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করতে শুরু করলেন। চাকরির  জন্যে ঘুরছেন,এমন সময়ে একটি গানের টিউশনি এলো।  পাশের পাড়ার গাঙ্গুলি বাড়ির বড়ো মেয়ে গৌরীকে গান শেখাতে হবে। মাস মাইনে ৭৫ টাকা। তা তখনকার দিনে বেশ ভালই। পরে এই গৌরীই হবেন ১৯৫০ সালে তাঁর জীবন সঙ্গিনী।

হ্যাঁ, কথা হচ্ছে অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সম্মন্ধে।১৯২৬ সালে ৩ রা সেপ্টেম্বর মামারবাড়ি কলকাতার আহিরীটোলায় জন্ম। জন্মের কয়েকমাস পরে মায়ের বাবার গুরুদেব হঠাৎ শিষ্যের বাড়িতে এসে হাজির এবং সেই শিশুটিকে দেখে বলেছিলেন, দেখিস এই শিশুর হাসি একদিন হবে ভুবন ভোলানো হাসি।

হ্যাঁ, বাঙালির ম্যাটিনি আইডল,বাংলা  চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তম কুমারের হাসি সত্যিই ছিল ভুবন ভোলানো হাসি। জীবনের শুরুতে পরপর ফ্লপ ছবি হয়েছে।

প্রতিদিন পাঁচ সিকে মজুরীতে সিনেমায় কাজ করেছেন। সিনেমাপাড়ায় একটা সময়ে তার নাম হয়েছিল ফ্লপ মাস্টার জেনারেল।

অরুণ কুমার,অরূপ কুমার,হয়ে শেষে পাহাড়ি সান্যালের কথামতো উত্তম কুমার নাম নিয়ে ১৯৫৩ সালে নির্মল দে-র ছবি “সাড়ে চুয়াত্তর ” মুক্তি পেল এবং উত্তম কুমারের পথ চলা শুরু হল সফলতার দিকে।

মানুষ হিসাবে সবার আড়ালে থেকে কাজ করে গেছেন। সিনেমা জগতের বহু মানুষের বিপদে আপদে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন,টাকা পয়সা দিয়ে,সশরীরে উপস্থিত থেকে,বিভিন্নভাবে।

অনেক পরিচালককে তিনি টাকা পয়সা দিয়ে সিনেমা তৈরীতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

এইসব কথা অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়, অভিনেতা তরুন কুমার, অভিনেতা মনি শ্রীমানী, পশ্চিম বঙ্গের প্রথম রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়,পরিচালক অজয় কর, বিভুতি লাহা,সলিল দত্ত,পীযুষ বসু, শক্তি সামন্ত,সঙ্গীতকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,শ্যামল মিত্র, ভিবালসারা প্রমুখ প্রমুখ দের বিভিন্ন আত্মকথায়, স্মৃতি চারনায় প্রকাশ পেয়েছে।

সারা জীবনে বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে ২৫০ টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। স্বয়ং সত্যজিৎ রায় তার নায়ক সিনেমার চিত্রনাট্য  লিখেইছিলেন উত্তম কুমারের কথা মাথায় রেখে।এই কথা স্বয়ং সত্যজিৎ রায় বলে গেছেন। উত্তম কুমার সিনেমা পরিচালনা করেছেন,প্রযোজনা করেছেন,সিনেমার সঙ্গীত পরিচালকের কাজও করেছেন।

এপার ওপার দুই বাংলার তথা সারা পৃথিবীতে যত বাঙালী আছেন এমন কোন বাঙালী নেই যিনি উত্তম কুমারের সিনেমা দেখেননি। মুগ্ধ হননি।

অনেক পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন। ১৯৮০ সালের আজকের দিনে,এই ২৪ শে জুলাই তিনি ওগো বধু সুন্দরী সিনেমার শুটিং করতে করতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চির শান্তির ঘুমের দেশে চলে গিয়েছিলেন।

বাঙালির সংস্কৃতির জগতে ঘটেছিল এক বিরাট নক্ষত্র পতন,এক সুবিশাল ইন্দ্র পতন।  বিদায় বেলায় তাঁর অন্তিম যাত্রার ধারাবিবরণী প্রচারিত হয়েছিল আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে।

তাই বাংলা ও বাঙালির কাছে উত্তম কুমার একটি যুগ, একটি অবধারিত সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক বাস্তবতা এবং ঐতিহ্য-এর ইতিহাস।

Related posts

আমাদের দেশ, আমাদের দ্বেষ-বিদ্বেষ এবং রবীন্দ্রনাথ

কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর, সে-দেহে তাহার কোন প্রমাণ ছিল না

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…