প্রথম পাতা খবর বাঘাযতীন তারপর কৃষ্ণনগরে মামার বাড়িতে আর আসেননি…

বাঘাযতীন তারপর কৃষ্ণনগরে মামার বাড়িতে আর আসেননি…

399 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

তখন ব্রিটিশ সরকার এদেশে রাজত্ব করছে। বাংলা, পাঞ্জাব-সহ সারাদেশে বিপ্লবীদের উত্থান পরাধীন দেশমাতৃকা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতিতে। ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা,পুলিশ বাহিনীর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল অগ্নিযুগের সেইসব বিপ্লবীরা। এমনই এক ঐতিহাসিক বিপ্লবী ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, যিনি বাঘাযতীন নামে ইতিহাসে খ্যাত।

যতীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার কুমারখালির কয়া (কেয়া) গ্রামে, (এখন বাংলাদেশে), ১৮৭৯ সালের ৭ই ডিসেম্বর। বাবার নাম ছিল উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম ছিল শরৎশশী দেবী। ৫বছর বয়সে যতীন পিতৃহারা হন। তারপর, মা শরৎশশী দেবী মেয়ে (যতীনের দিদি) বিনোদবালা এবং ছেলে যতীন-কে নিয়ে বাপেরবড়িতে চলে আসেন।

যতীন ভর্তি হন কৃষ্ণনগরের এংলো ভার্নাকুলার (এভি) স্কুলে। ১৮৯৮ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতায় পড়তে আসেন। কলকাতায় আসার পরে তিনি ধীরে ধীরে যুক্ত হন অনুশীলন সমিতির যুগান্তর গোষ্ঠীর সাথে। তিনি অরবিন্দ ঘোষ,বারীন্দ্রনাথ ঘোষ,প্রমুখ বিপ্লবীদের সান্নিধ্য লাভ করেন। তিনি স্বামী বিবেকানন্দের, ভগিনী নিবেদিতা-র সংস্পর্শেও আসেন এবং দেশমাতৃকাকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করার জন্য বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হন। যতীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বৈপ্লবিক কাজকর্ম সেই সময়কার ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ গোয়েন্দাদের নজরে আসে।ব্রিটিশ সরকার যতীন্দ্রনাথের ভয়ে আতঙ্কে ভুগতে থাকে।যেনতেন প্রকারে যতীন্দ্রনাথ-কে খুঁজে বের করে গ্রেফতার করতেই হবে।চারিদিকে ব্রিটিশ পুলিশ ওঁত পেতে থাকতো। ফলে, যতীন্দ্রনাথ-কে আত্মগোপন করতে হতো বিভিন্নভাবে বিভিন্ন গোপন আস্থানায়। এইরকম-ই একবার তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন তাঁর মামারবাড়ি কৃষ্ণনগরে। কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজরে আসে এই গোপন আস্থানার খবর।একদিন ভোর রাতে বিশাল ব্রিটিশ পুলিশবাহিনি যতীনের গোটা মামারবাড়ি ঘিরে ফেলেছিল। সেই নজরদারি এড়িয়ে পালাবার কোন পথই ছিল না। এত আঁটোসাঁটো ছিল সেই তল্লাসির কড়াক্কড়ি।

সেইযুগে সাধারণত শহরে,নগরে,মফস্বলের সকলের বাড়িতেই থাকতো খাটা পায়খানা। আর,সেই পায়খানা সাফ করতে আসতো যারা,তাদের বলা হতো “মেথর”। যতীন্দ্রনাথ সেই মেথরের ছদ্মবেশ ধরে ব্রিটিশ পুলিশের সামনে দিয়ে, ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে,মামারবাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর আর তিনি কোনদিন নদীয়ার কৃষ্ণনগরের মামারবাড়িতে আসেননি।

তারপরের ইতিহাস এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস। তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে উড়িষ্যার বালেশ্বরের বুড়িবালাম নদীর তীরের ঐতিহাসিক “বুড়িবালামের যুদ্ধে”। ব্রিটিশকে যুদ্ধে পরাস্ত করেছিলেন,কিন্তু নিজে অন্যান্য সহ-বিপ্লবীদের সাথে শহীদের মৃত্যু বরণ করেন।

এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করা দরকার। যতীন্দ্রনাথ উড়িষ্যায় যাওয়ার আগে তখন আত্মগোপন করে আছেন হাওড়া জেলার বাগনান এলাকায়।একদিন তিনি শুনলেন,যে দুপুরের রেলগাড়িতে মেদিনীপুর যাবেন শ্রীমা সারদাময়ী দেবী।তিনি মেদিনীপুর থেকে তারপর যাবেন আরামবাগ। সেখান থেকে কামারপুকুরের আগে কোয়ালপাড়াতে যাবেন তিনি। এই খবর শুনে যতীন্দ্রনাথের অনেকদিনের মনের একান্ত সাধ শ্রীমা-কে প্রণাম করার,আশীর্বাদ নেওয়ার ইচ্ছা-বাসনা জেগে উঠলো। তিনি যথাসময়ে শ্রীমা যে গাড়িতে আসছিলেন,তাতে উঠে পড়লেন,এবং অনেক খুঁজে খুঁজে শ্রীমা- র কামরায় গিয়ে শ্রীমা-কে প্রণাম করে মায়ের আশীর্বাদ নিয়েছিলেন।তিনি শ্রীমায়ের কোলে মাথা রেখে মায়ের আশীর্বাদ নিয়েছিলেন। এইসব কাহিনী জানা যায় বিপ্লবী এবং শ্রীমায়ের স্নেহধন্য শিষ্য দেবব্রত ঘোষের লেখা থেকে। দেবব্রত বাবুও পরবর্তীতে শ্রীরামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। সে এক অনির্বচনীয় ইতিহাস।

এরপরের ইতিহাস সকলেরই জানা।উড়িষ্যার বালেশ্বরে বুড়িবালামের তীরে ব্রিটিশ পুলিশবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে যতীন্দ্রনাথ গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছিলেন।

এখানে উল্লেখ্য, যে বিপ্লবী দলে যুক্ত হওয়ার পরে একটি ঘটনাচক্রে তিনি সরাসরি একটি বাঘের সঙ্গে লড়াই করে তিনি বাঘ-কে জব্দ করেছিলেন। সেই থেকে যতীন্দ্রনাথের নাম হয়েছিল ” বাঘাযতীন”।

যতীন্দ্রনাথের পৈতৃক বাড়ি ছিল অবিভক্ত নদীয়া জেলার সাধুহাটির রিশখালি-র ঝিনাইদহে। বাঘাযতীনের বয়স তখন ৩৬ বছর,যখন তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লবী হিসাবে বুড়িবালাম নদীর তীরে ১৯১৫ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর শহীদের মৃত্যু বরণ করেন।

বাঘাযতীনের বড়োমামা বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আইনজীবী এবং তিনি ছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির শিলাইদহ এস্টেটের(এখন বাংলাদেশে) অন্যতম আইনি পরামর্শদাতা।

যতীন্দ্রনাথের ছোটমামা ছিলেন ললিত কুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি সেই সময়ে রাজনৈতিক কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন,এবং বামপন্থী ছিলেন।ললিতকুমারের পুত্র ছিলেন মোহিত চট্টোপাধ্যায়। আর এই মোহিত চট্টোপাধ্যায় হলেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম নক্ষত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাবা। সেই অর্থে, এই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হলেন বাঘাযতীনের সম্পর্কে ভাইপো।

যাইহোক, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘাযতীন ব্রিটিশের গোয়েন্দাদের এবং পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে কৃষ্ণনগরের মামারবাড়ি থেকে মেথরের ছদ্মবেশ ধরে পালিয়েছিলেন,তারপর তিনি মামারবাড়িতে আর কোনদিন আসেননি।

ভাবলে অবাক হতে হয়, আমরা এই প্রজন্মের যারা, তারা আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এইসব বীর বিদ্রোহী বিপ্লবীদের জীবনের অনেক ইতিহাস-ই জানি না। যা আমাদের দেশের, আমাদের অতীতের এক ঐতিহাসিক স্বরণীয় অধ্যায়, এক গৌরবগাথা।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.