প্রথম পাতা খবর “সম্ভবামি যুগে যুগে…”

“সম্ভবামি যুগে যুগে…”

211 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

ইদানিং সমাজের বিভিন্ন স্তরে অত্যন্ত আলোচিত বিষয়টি হোল “গীতা” কী? আদৌ গীতায় কোন সারবত্তা আছে কি? এই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু আলোকপাতের প্রয়োজন।

প্রশ্ন জাগে,যে শ্রীমদ্ভাগবত গীতা কি ধর্মীয় গ্রন্থ? এই গ্রন্থ কি শুধুমাত্র কোনও একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের? এই গ্রন্থে কি শুধুই যুদ্ধের উন্মাদনা আছে?বা যুদ্ধের প্রতি উত্তেজিত করার প্রবণতা আছে..? ইত্যাদি ইত্যাদি।

আসলে,শ্রীমদ্ভাগবত গীতা-কে আদালতে সাক্ষীর মিথ্যা বয়ানকে প্রতিহত করার জন্য তাতে হাত রেখে শপথ নেওয়ার কাজটাকে আমরা দেখতে অভ্যস্ত, আর সেই গীতায় হাত রেখে, ‘যাহা বলিব সত্য বলিব’- একথা বলার পরেও বেমালুম মিথ্যে কথা বলে যায় অনেকেই।এই অভিজ্ঞতা আমাদের মনে এক নেতিবাচক ধারনার জন্ম দেয়,আসলে গীতাকে তো অসম্মান করা হয় তাতে। কারন, আদালতের বিচারক,আইনজীবীরা, সাধারণ মানুষ,সমাজের সব শ্রেণীর মানুষই জানেন যে আদালতে,বিচারে মিথ্যার জাল বিছানো থাকে।রবীন্দ্রনাথের কথায়,”বিচারের বাণী নীরবে,নিভৃতে কাঁদে..”।

এছাড়া,আর একটি দিক আছে,সেটি হল গীতাকে আমরা শাস্ত্র বলে একটা বিশেষ শ্রদ্ধা করতে শিখেছি।পড়িনি কেউ সবিস্তারে। আর গীতার ব্যবহার দেখি আমরা,হিন্দুধর্মের কেউ মারা গেলে,তার শ্রাদ্ধে গীতা পাঠ হয়, পাঁচ বা দ্বাদশ ব্রাহ্মণ-দের সম্মানী উপহার হিসাবে যে সামগ্রী দেওয়া হয়,তাতে একটি করে গীতা দেওয়া হয়। ব্যস,গীতার ব্যবহার এইটুকুতেই সীমাবদ্ধ। বোধহয়,আমাদের অজ্ঞতা,আত্মম্ভরিতা থেকেই আমাদের গীতার প্রতি এই কুপমণ্ডুকময় দৃষ্টিভঙ্গী।

আসলে গীতার সারমর্মই আমরা অনুধাবন করতে বোধহয় পারিনি। গীতার ১৮ টি অধ্যায়ে ৭০০ শ্লোক আছে। গীতা অনুষ্টুপ ছন্দে গ্রন্থিত,কয়েকটি শ্লোক ত্রিষ্টুপ ছন্দে গ্রন্থিত। প্রত্যেকটা অধ্যায়ের নামকরণের শেষে “যোগ” শব্দটা আছে।এই যোগ শব্দের মানে হোল যুক্ত করা বা হওয়া। ইতিহাস বলে গীতার জন্ম কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন-এর প্রতি শ্রীকৃষ্ণ-এর বাণীর উচ্চারণ হিসাবে,যা সমগ্র মানবজাতির শুভাকাঙ্ক্ষীত কল্যানেই অমূল্য এবং প্রণিধান যোগ্য। তা কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের বা গোষ্ঠীর একার নিজস্ব নয়। এমনকি গীতার কথা কোনও দেশ বা কালের গণ্ডীর মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়। জার্মান দার্শনিক পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার গীতাকে “পঞ্চম বেদ” বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

গীতার ৪র্থ অধ্যায় থেকে আমরা জানতে পারি,যে শ্রীকৃষ্ণ গীতার জ্ঞানরাশি প্রথমে দিয়েছিলেন বিবস্বানকে(৪/১)।

গীতার সঙ্গে শুধু হিন্দুধর্মের যোগ, তা কিন্তু নয়।যে কোনও জাত-ধর্ম-এর মানুষের অধিকার আছে গীতা পড়ার,তার সারমর্ম অনুধাবন করার। বিখ্যাত সাহিত্যিক,এবং সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত,রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য সৈয়দ মুজতবা আলি বলেছিলেন, –“গীতার মতো গ্রন্থ,সারা পৃথিবীতে বিরল,আর নেই বলা যায়। তার প্রধান কারণ, গীতা সর্বযুগের সর্বমানুষকে সব সময়েই কিছু না কিছু দিতে পারে। আধ্যাত্মিকতার চরম সম্পদ পেতে হলে গীতাই অত্যুত্তম পথ প্রদর্শক,আর ঠিক তেমনি ইহলোকের পরম সম্পদ পেতে হলে গীতা যে রকম প্রয়োজনীয় চরিত্র গড়ে দিতে পারে,অন্য খুব কম গ্রন্থেরই সেই শক্তি আছে। আমার মতো ঘোর চরম নাস্তিকও গীতা পাঠে উপকৃত হয়।”(“গীতা-রহস্য”//ময়ুরকণ্ঠী)।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-“গীতা আজও পুরাতন হয়নি,কোনও কালেই পুরাতন হবে না”। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন -“গীতা একটি দার্শনিক গ্রন্থ। সেখানে জ্ঞান,মূল্যবোধ, অস্তিত্ব, জীবন সম্পর্কে মৌলিক প্রশ্নগুলির অধ্যয়ন হয়।তাতে করে অনেক সময়ে আমাদের ক্ষত্রতেজ বিনষ্ট হয়।কিন্তু এখন এদেশের প্রয়োজন সব বজ্জাতগুলোকে ঝেঁটিয়ে তাড়ানোর,আর তার জন্য চাই শক্তপোক্ত শরীর, তাই গীতাপাঠ এখন কিছুদিনের জন্য শিকেয় তুলে ফুটবলে লাথি মার।”(প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য)। আমাদের দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিপ্লবীদের কাছে থাকতো গীতা।তাঁরা অনুপ্রেরণা পেতেন গীতা থেকে,তাঁরা পড়তেন নিয়মিত।সেই ইতিহাস আমরা সকলেই কমবেশি জানি।সত্যাগ্রহ আন্দোলনে গান্ধীজি গীতার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। নেতাজী যখন ১৪/১৫ বছরের কিশোর, তখন তিনি নিয়মিত গীতা পড়ে তার সারমর্ম অনুধাবন করার চেষ্টা করতেন,ধ্যান করতেন,দেশমাতৃকার আরাধনা করতেন,নিজেকে স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে তৈরী করতেন।

যীশুখ্রীস্ট-এর ভক্ত এবং শিক্ষাবিদ Annie Besant সমগ্র গীতাকে পড়ার পরে নিজে মূল সংস্কৃত ভাষাথেকে ইংরাজিতে translate করেছিলেন,যা ১৯০৪ সালে প্রথম প্রকাশ পায়। তিনি গীতাকে বলেছিলেন -“The Lord’s Song”. এই অনুদিত বইটি একই সাথে প্রকাশিত হয়েছিল Adyar,Madras-600020, থেকে,এবং, Great russel street,London, থেকে,আর প্রকাশ পেয়েছিল Weaton,Illinois,60187, U.S.A.থেকে।

বিশ্ব-বিখ্যাত গণনেতা হো-চি-মিন গীতা সম্বন্ধে বলেছিলেন,-” আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা, কিন্তু আপনাদের একটি জিনিসকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি,সেটি হলো গীতা।” (কথোপকথনে হো-চি-মিন) তাই গীতা হিন্দুর নয়,মুসলমানের নয়, খ্রিস্টানদের,জৈনদের,বৌদ্ধদের, বা কোনও জাত-ধর্ম-এর নয়,গীতা হোল সমগ্র মানব জাতির অমূল্য সম্পদ।

না গীতায় শ্রীকৃষ্ণ তৃতীয় পান্ডব অর্জুন- কে যুদ্ধ করতে উত্তেজিত করেননি।যদিও অনেকেই তাই বলে। কিন্তু আসলে শ্রীকৃষ্ণ বলেছিল অর্জুন-কে–” ইতি তে জ্ঞানমাখ্যাতং গুহ্যাদ্গুহ্যতরং ময়া।/ বিমৃশ্যৈতদশেষেণ যথেচ্ছসি তথা কুরু।।”(১৮/৬৩) এই “যথেচ্ছসি তথা কুরু” কথাটির মানে হল “যা ইচ্ছা তাহা-ই করো”–তবে গভীর ভাবে আগে তা ভেবে করো। এর জবাবে অর্জুন
বলেছিলেন -” নষ্টো মোহঃ স্মৃতির্লব্ধা ত্বৎ প্রসাদান্ময়াচ্যুত।/ স্থিতোহস্মি গতসন্দেহঃ করিষ্যে বচনং তব।।”(১৮/৭৩) মানে, তার মোহ কেটে গেছে,সব সন্দেহ দুর হয়েছে।

তাই একথা বলাই যায়, যে গীতা হলো নীতি বিষয়ক এক পরম গ্রন্থ।এবং তা সমস্ত মানবজাতির। তাই এই প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানী, দার্শনিকেরা গীতাকে কোনও রকমের ধর্ম বা সম্প্রদায়ের একক সম্পত্তি হিসাবে দেখেন না,দেখেন মানবসভ্যতার মহাসম্পদ হিসাবে। গীতায় যে বিধ্বংসী রূপের কথা বলা হয়েছে(১১/৩২),সেই বিধ্বংসীতার সাথে মিল খুঁজে পেয়েছিলেন পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পরে রবার্ট ওপেনহাইমার। বিশ্ব বিখ্যাত ইংরেজি সাহিত্যের মানুষ টি.এস.এলিয়েট একজায়গায় মন্তব্য করেছিলেন,-“পৃথিবীর দুটি শ্রেষ্ঠ গীতিকাব্যের অন্যতম শ্রীমদ্ভাগবত গীতা..”।

তাই গীতাকে কোনভাবেই কোনও গন্ডির মধ্যে রাখা যাবেনা। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন–” গীতা গীতা’বারবার উচ্চারণ করলেই ত্যাগী হওয়া যায়।” তিনি এই কথাটি বলেছিলেন আমাদের মধ্যে যাবতীয় অসদাচারের বিনষ্ট হওয়ার বিষয় নিয়ে।যেমন আমাদের বহুল প্রচলিত একটি কথায় বলে,যে, -” রুচুক, না রুচুক খাও তিতা,/বোঝো,না বোঝো,পড়ো গীতা।”

আসলে আমাদের মনে,ভাবনায় যে অন্তর্দ্বন্দ্ব সদা-সর্বদা চলে,চলতে থাকে,তার নিরসনের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় গীতায়।দ্বিধাবোধ-এর উৎস খুঁজে পাওয়া যায় গীতায়। তাই গীতাকোনও ধর্ম নয়,ধর্মীয় গ্রন্থও নয়,গীতা হোল আমাদের জীবনশৈলীর পথ-নির্দেশ, পথ-প্রদর্শক।

কি রকম জানেন?…ধরুন, আগুনের মধ্য থেকে যদি তার দাহিকাশক্তি উত্তাপকে সরিয়ে ফেলা হয়,তাহলে আগুন তার অস্তিত্ব হারাবে,নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে,অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। বা ধরুন,জলের থেকে যদি তার শীতলতা,তরলতা, প্রবহমানতা,ইত্যাদিকে সরিয়ে ফেলা হয়,তাহলে আমাদের অস্তিত্বের সংকট দেখা দেবেই। ঠিক তেমনই, আমাদের মানবজীবন থেকে যদি গীতার philosophy কে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়,তাহলে,আমাদের আত্মা-ই থাকবেনা,থাকবে শুধু এই জড়,অসার দেহ বা বস্তুটা।

তাই মাঠে ময়দানে গীতার উৎসব নয়,প্রয়োজন গীতার সারমর্মকে উপলব্ধি করার জন্য তাকে সঠিকভাবে গ্রহন করা। আজ বিদেশের বহু দেশে গীতার সারাংশ নিয়ে আলোচনা হয়,জীবনের উন্নতিতে,কাজের উন্নয়নে,ইত্যাদিতে।আসলে,আমরা উন্নতির বা development এর সঠিক মর্মার্থ বুঝতেই পারিনা,বা বুঝতে চাইনা।কারন হিসাবে বলা যায়,মানব সভ্যতায় এবং স্ব স্ব মানব চরিত্রে দুই রকমের development হয়,বা হওয়া উচিৎ। এক,আমাদের চারিপাশে পারিপার্শ্বিক যে সামগ্রিক বস্তুবাদী development, তাকে বলা হয় vertical development যা,surrounded parallel development. আর একটি development হওয়া উচিৎ, তা হোল,ব্যক্তির নিজের মধ্যে বা বস্তুর,বা বিষয়ের মধ্যে internal development যাকে বলা যেতে পারে vertical development বা আত্মিক উন্নয়ন।এইটি নিয়ে আজ সারাবিশ্বে আলোচনা চলছে বিভিন্নভাবে।সেখানে এই গীতার মূল্যবোধেরই চর্চা হয়।

তাই গীতার সঠিক ব্যবহার করাই আমাদের কাম্য।তাকে আদালতে সাক্ষীর শপথের জন্য ব্যবহার করার দরকার নেই,দরকার নেই কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করার,বা কোন শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে তার ব্যবহারের।

গীতা আমাদের মানবসভ্যতার অতি মূল্যবান সম্পদ।তাকে যথাযথ সম্মান দিয়ে রক্ষা করাই আমাদের একান্ত আপন কর্তব্য। গীতা হোল সব জাত-ধর্মের শাশ্বত গ্রন্থ।গীতার কোথাও কোন শ্লোকেই হিন্দু শব্দটি নেই। এটা লক্ষ্য করবেন।কারিন হিন্দু কোন ধর্মীয়,শব্দ নয়,Hinduism is not a religion, it’s a civilization,and Hinduism is the mother of all religions.. “(স্বামী বিবেকানন্দ /চিকাগো)।

এওকথা অনস্বীকার্য যে,একমাত্র গীতাই বলতে পারে…মানব সভ্যতায় অস্তিত্বের সংকট এলেই… সেই সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মানুষের মধ্যে এসে উপস্থিত হবেই মহামানব সমস্ত সমাধানের প্রস্তুতি নিয়ে। গীতার কথায়– “সম্ভবামি যুগে যুগে…”।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.