পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
আজ ৭৭ বছরের আমাদের দেশের স্বাধীনতা। তবুও আজও অনেক অনেক অজানা ইতিহাস আমাদের আশেপাশেই রয়েছে,আমরা জানিই না।
যেমন একটি নাম যতীশ গুহ।নামটা বেশীরভাগ মানুষই শোনেননি।না শোনাটাই স্বাভাবিক,না চেনাটাই স্বাভাবিক। আরে শুনবেন কি করে? এই নামটা যে আরও অনেক অনেক নামের মতো ইতিহাসের পাতা থেকেই মুছে দেওয়া হয়েছে। তাহলে শুনুন,..এই সেই যতীশ গুহ..যার সঙ্গে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সেই ঐতিহাসিক মহানিষ্ক্রমনে এবং অন্তর্ধানে সক্রিয় ভূমিকা ছিল। সেই ইতিহাস জেনে নিই, আসুন।
তার আগে জেনে নিন,সেই সময়ে যতীশ গুহ ব্রিটিশ সরকার দ্বারা গ্রেফতার হওয়ার পরে তাকে ব্রিটিশরা নিয়ে চলে যায় দিল্লির লালকেল্লাতে।সেখানে জেলে বন্দী অবস্থায় থাকাকালীন যতীশ গুহ-র ওপরে অকথ্য অত্যাচার চালানো হতো রোজ,…প্রায় চার বছর ধরে।বিপ্লবী যতীশ গুহের মলদ্বারে রুল ঢুকিয়ে, আঙুলে পিন ফুটিয়ে, রোজ বুকে পিঠে লাঠির আঘাত করে,মেঝেতে শুইয়ে ক্রমাগত লাথি মেরে মেরে অত্যাচার করতো ব্রিটিশ পুলিশের লোক,তার মধ্যে ভারতীয় মানুষও ছিল।
একবার মনে মনে কল্পনা করুন,অনুভব করুন,সেই ঘটনার দৃশ্যগুলি,…না একবারের জন্যও সেদিন যতীশ গুহ মুখ খোলেন নি,নেতাজীর মহানিষ্ক্রমনের বিষয়ে। অবশ্য শেষে যতীশ গুহ সেই অত্যাচারে অত্যাচারে জর্জরিত হতে হতে শেষে একদিন জেলের মধ্যেই মারা যান,বলা যায় শহীদ হন।
ভাবছেন তো!? নেতাজীর মহানিষ্ক্রমনের সাথে যতীশ গুহ-র সম্পর্ক কি করে? এই ইতিহাস সচরাচর বাজার চলতি কোনো বইতে পাবেন না। আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই কথা।
১৯৪১ সালের ১৭ ই জানুয়ারী গভীর রাতে ১টা ১৫/২০ মিনিট নাগাদ, নজর-গৃহবন্দী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু কলকাতার এলগিন রোডের বাড়ি থেকে একটি কালো গাড়িতে করে অন্তর্ধান করলেন এবং গোমার দিকে রওনা হয়েছিলেন আমরা জানি।গাড়ির চালক ছিলেন ভাইপো শিশির বসু। সেদিন সেই প্রচন্ড ঠান্ডার রাতে এলগিন রোডের বাড়ির সামনে মাত্র দু’জন চৌকিদার পাহারাতে ছিল,এবং তারা তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল।আর গাড়িটা অমনি অমনি বেরিয়ে চলে গেল?? কি সহজ সরলভাবে আমাদের ইতিহাস জানানো হলো, তাই না!!??
আসুন এবার ঘটনাটিকে অন্য বাস্তবতায় দেখি। আমরা জানি যে ব্রিটিশ সরকার এর একমাত্র এবং পয়লা নম্বর শত্রু ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। সেই তিনি যখন জেলবন্দী অবস্থায় শরীর খারাপের কারনে এলগিন রোডের বাড়িতে নজরবন্দী হলেন,তখন সেই এলগিন রোডের বাড়ির বাইরে থাকতো ৬/৭ স্তরের পুলিশি প্রহরা।নেতাজীর ওপরে ২৪ ঘন্টা নজর রাখতো ১৫/১৬ জন ব্রিটিশ গোয়েন্দা অফিসার। সব গেট বন্ধ থাকতো। কেউ বাড়িতে এলে,বা,বাইরে গেলে তল্লাসি করতো পুলিশ। সব তথ্য লেখা হতো রেজিস্টারে। এহেন কড়া পাহারায় একটা গাড়ি বেরিয়ে যাবে অতি সহজে,এটা অসম্ভব। কিন্তু সেদিন কিভাবে নেতাজী বেরিয়ে গিয়েছিলেন, সে ঘটনা এক বিতর্কিত অজানা ইতিহাস। যা আজও সঠিকভাবে উন্মোচন হয়নি।তবে সেই মহানিষ্ক্রমনের ইতিহাসের পুরোভাগে যারা সেদিন ছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন এই যতীশ গুহ।
এছাড়াও ছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লকের লালা শঙ্করদয়াল,সর্দার শার্দুল সিং,মহম্মদ জিয়াউদ্দিন (যে নামে এবং ছদ্মবেশে নেতাজী চলে গিয়েছিলেন),মিস্টার পরমানন্দ্,এই ঘটনায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন।আর সরাসরি যুক্ত ছিলেন পরিকল্পনার নেতৃত্বে স্বয়ং নেতাজী। এছাড়াও যুক্ত ছিলেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-এর যতীশ গুহ, সত্যরঞ্জন বক্সী,সুধীর রঞ্জন বক্সী,হরিদাস মিত্র,প্রমুখরা।নেতাজীর পরিবারের যে সদস্যরা যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দ্বিজেন বসু,ইলা বসু,অরবিন্দ বসু,রণজিৎ বসু,শিশির বসু,সুধীর বসু,মীরা বসু,প্রমুখরা। আমরা এদের খবর জানিই না।
যেমন আমরা জানি না, চিনিনা শহীদ রামকৃষ্ণান-কে। যিনি নেতাজীর রাশিয়া যাবার পথের সন্ধান করতে গিয়ে আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ান ভুখন্ডের মধ্যে আমুর নদীতে ডুবে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন। তখনও নেতাজী এলগিন রোডের বাড়িতে নজরবন্দী অবস্থায়।পরে নেতাজী এই কথা জেনেছিলেন কাবুলে উত্তমচাঁদের বাড়িতে।
নেতাজীর মহানিষ্ক্রমনের বেশ কিছুদিন পরে ব্রিটিশ সরকার যখন জানলো,তখন শুরু হোল পরাজিত,হতভম্ব ব্রিটিশ সরকারের হম্বিতম্বি। শুরু হোল দেশে বিদেশে ব্যাপক তল্লাসি।
এই যতীশ গুহ, সত্যরঞ্জন বক্সী, সুধীররঞ্জন বক্সী,সর্দার শার্দুল সিং,মহম্মদ জিয়াউদ্দিন, অরবিন্দ বসু,রণজিৎ বসু,প্রমুখকে গ্রেফতার করে লালকেল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়।শুরু হয় অকথ্য অত্যাচার। সেখানেই যতীশ গুহ শহীদ হন।
তারপর সে এক বিরাট ইতিহাস।সে কাহিনি বিস্তারিত জানবো অন্য কোনও একদিন।
বন্দে মাতরম…জয় হিন্দ…ইনকিলাব জিন্দাবাদ…
জয়তু নেতাজী সুভাষ. …
প্রণাম রইল এদেশের অসংখ্য জানা অজানা বীর বিদ্রোহী বিপ্লবী শহীদদের প্রতি….
(তথ্য ঋণ…ক্ষমা কর সুভাষ / ডঃ জয়ন্ত চৌধুরী।
সুভাষ ঘরে ফেরে নাই/ শ্যামল বসু।
“Bose….the forgotten Hero”—/Shyam Benegal.)