চৈত্র বৈশাখ মধুমাধবের মায়ায় মায়ায়

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

চৈত্র সংক্রান্তি আর নববর্ষের পয়লা– মধুমাধবের এই যুগলবন্দীর মায়ায় মায়ায় সেই কোন যুগ থেকে বাঙলা ও বাঙালি পালা পার্ব্বনের আর উৎসবের অংশীদার। তার নিত্যদিনের আটপৌরে হাসিকান্নার,সুখ-দুঃখের জীবনে এই চৈত্র সংক্রান্তি আর পয়লা বৈশাখ পরম্পরাগত এক ইতিহাস।

চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব মানে,নীলষষ্ঠী, গাজন,চড়কের মেলা।যার শুরু চৈত্রের পয়লা তারিখ থেকে,চড়কের বা গাজনের ব্রত নেওয়া গাজন সন্ন্যাসীদের সেই সুরটানা “বাবা তারকনাথের চরণের সেবা লাগে,মহাদেব..” আওয়াজ,যা বাঙালির কানে কানে শৈশব থেকেই প্রবেশ করেছে,আজও চলে আসছে সেই প্রবহমানতা।

শহুরে জীবন থেকে একটু বেরিয়ে যদি যাই,আমরা জানতে পারবো গ্রাম বাংলার এই চৈত্র সংক্রান্তিকে কোথাও কোথাও নীলের গাজনও বলা হয়। সন্তানদের মঙ্গল কামনায় বঙ্গনারীদের নীলষষ্ঠী ব্রত পালন করা। শিবের মাথায় জল,দুধ ঢালা।শিবের আরেক নাম নীললোহিত, আর সেখান থেকেই হয়তো এই নীলষষ্ঠী নাম।

আমাদের অনেক পুরাতন লেখাতেও আমরা এই পুজোর খোঁজ খবর পাই। আজ থেকে ১১০ বছর আগের ” ভারতী”(১৩২১ বঙ্গাব্দ) পত্রিকায় প্রকাশিত শীতলচন্দ্র চক্রবর্তীর লেখায় পাই,এই নীলষষ্ঠীর কথা।পাই বৃহদ্ধর্ম পুরাণে।তবে শাস্ত্রে এই চড়ক বলে কোনও উৎসব কে পাওয়া যায়না।যদিও, মহাবিষুব সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত এই চড়ক পুজার সঙ্গে হরগৌরীর যোগ ছিল সুদুর প্রাচীনকাল থেকেই। দুর্গাপূজার মতো গ্রামে গ্রামে ঢাকঢোল,কাঁসর,বাদ্যি বাজিয়ে ধুমধাম পালপাব্বন হতো।

আসলে,প্রায় ছয়মাস একেবারে নরম নরম হয়ে থাকার পরে এই মধুমাধবে, মানে চৈত্র বৈশাখের সময়ে বসন্তের নীল আকাশের নীল-নীলিম শোভায় রক্তবর্ণ সূর্য বিবস্বান প্রকাশিত হন,প্রকট হন।তাঁর অভিনন্দনের জন্য যে অনুষ্ঠান, সেটাই নীলপুজো,বা চড়ক রূপে সমাদৃত হয়ে আসছে। এই সময়কে ঘিরেই প্রজাপতি দক্ষ কন্যা সতীর সঙ্গে দেবাদিদেব মহাদেব তথা শিবের বিবাহের কল্পনা।

নীলবর্ণ আকাশ আর রক্তবর্ণ প্রভাতসূর্য -এর যে মিলন,তাই হলো শিব-সতী(শক্তি),বা হরগৌরীর মিলন। আমাদের ইতিহাসে শিব হলেন প্রান্তিক মানুষের দেবতা,তাঁর অনুচরের দল সব ভুত,প্রেতে ঠাসা। দরিদ্র মানুষের প্রতীক।

“পুজা পারব্বনের উৎসকথা”-য় চড়ক,গাজন প্রসঙ্গে পাই,– যে,এই চড়ক কথাটি “চক্র” কথার অপভ্রংশ হতে পারে।কারন চক্র হলো সূর্যদেবের আরেক নাম।ফলে চড়ক এক ধরনের সূর্যবন্দনাও।

আমাদের রীতিতে পাওয়া যায় চড়কের গাছ বা দন্ডটিকে সারা বছর জলে চুবিয়ে রাখা হয়।তারপর, চড়কের সময়ে পুজো করে সেই দণ্ডটি মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। এখানে মাটি বা এই পঞ্চতপা পৃথিবী হলেন সতী গৌরী,আর দন্ড বা গাছটি হলেন শিব।
চড়কের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় চড়কতলায় মেলার পসরা বসে।চড়কের গাছ থেকে চড়ক সন্ন্যাসীদের নানা রকমের শারীরিক কসরত দেখানো হয় শিবের নামে সোচ্চার হয়ে। সপরিবারে বাঙালি যায় মেলায়। বিশেষ করে শিশুরা,বালক,বালিকা,কিশোর কিশোরী সহ নানান বয়সী মানুষ যান এক অনাবিল আনন্দে সেই চড়কতলায়। সেই উৎসবে।

চড়কের হাত ধরে পায়ে পায়ে বাংলার উঠোনে,বারান্দায় এসে নামে পয়লা বৈশাখ। শুরু হয় বাংলা নববর্ষের আনন্দযজ্ঞ।বয়ে চলে বাঙালির জীবনে নতুনখাতা,হালখাতার আনন্দধারা। বসন্তের বিদায় বেলায় বসন্ত দিয়ে যায় তার ভালোবাসার যাবতীয় সব এমন কি তার বাঁশিটি পর্যন্ত নববর্ষের দিনে পয়লা বৈশাখের শুভ লগ্নে,মহা সন্ধিক্ষণে আসন্ন দাবদাহে জর্জরিত গ্রীষ্মের হাতে।

আজ সেই নববর্ষের প্রথম দিন। সকলের জন্য রইল শুভ নববর্ষের আন্তরিক অভিনন্দন শুভেচ্ছা আর শুভকামনা। সকলে ভালো থাকবেন।

Related posts

কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর, সে-দেহে তাহার কোন প্রমাণ ছিল না

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী