২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

তোমার কি মনে আছে সেই কথা, পিচ আর পাথরের কলকাতা, আমার মায়ের, বোনের, প্রিয়ার রক্তে রাঙানো সেই ইতিহাসের কথকতা…সেদিন ছিল ২৭ শে এপ্রিল।

না এমনটা হবে কেউ ভাবতেই পারেনি। সে ছিল এক শোকাহত শোকাবহ গোধুলির কলকাতা–রাজপথে ছিটকে পড়ে আছে মানুষের মাথার ঘিলু কলকাতার বৌবাজার স্ট্রীটে। পিচ কালো রাজপথ এক মুহুর্তে তাজা টাটকা রক্তে ভিজে হয়ে উঠেছিল সেদিন টকটকে লাল। সেই রক্তের লাল রঙ ছিল যেন গনগনে আগুনের শিখা। সেই রক্ত,সেদিন ঘন নিকষ কালো অন্ধকারে,যুগে যুগে যাঁরা আলো হাতে মানুষকে পথ দেখান,সেই তাঁদের,যাঁরা কোনদিন মরেও মরেন না…যাঁদের কথায় আমরা চিরদিন জেগে থাকি,জেগে উঠি,জাগিয়ে রাখি ইতিহাসকে,প্রতিবাদ কে প্রতিরোধকে। আজ সেইসব কথা স্মরণ করার দিন।ওরা ১৯৪৯ সালের ২৭ শে এপ্রিলের রক্তপথের মৃত্যুঞ্জয়ী অমর আলোর যাত্রী। সদ্য স্বাধীন দেশের মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির নেত্রী ও সংগঠক লতিকা সেন, প্রতিভা গাঙ্গুলি, অমিয়া দত্ত এবং গীতা সরকারের রক্তে ভিজেছিল কলকাতা রাজপথ। সাথে ছিল ছাত্র বিমান ব্যানার্জি,সুশীল চক্রবর্তী, কৃষক কর্মী প্রভাত কুণ্ড। জন্ম নিয়েছিল সেদিন ঐতিহাসিক “নারী শহীদ দিবস”।

১৯৪২ সালে বাংলা উড়িষ্যা,বিহার সহ এই বিরাট অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়েছিল।এর পেছনের কারন ছিল ব্রিটিশ আর তাদের বশংবদদের ষড়যন্ত্র। ১৯৪৭-এ দেশ স্বাধীন হবার পরে দেশের দায়িত্ব নিয়েছিল কংগ্রেস দল। কিন্তু তারা ছিল জমিদার জোতদারদের প্রতিনিধি।মানুষের দাবী দাওয়া কংগ্রেস দলের সরকার উপেক্ষা করেছিল,অস্বীকার করেছিল।ফলে পুঞ্জিত অভিমান,বঞ্চিত ক্ষুব্ধতা,একসময়ে পরিণত হয়েছিল গণ বিক্ষোভের রূপে। ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ, কায়ুর শহীদদের আত্মদান,পুন্নাপ্রা-ভায়ালারের মতো সংগ্রাম,বাংলায় তেভাগা আন্দোলন, ইত্যাদি। মানুষের বিরুদ্ধে অত্যাচার নিয়ে নামে সেই সময়ের কংগ্রেস সরকার আর তার পুলিশ বাহিনী। পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রাণ হারান কাকদ্বীপ, ডোঙ্গাজোড়া, চন্দনপিঁড়ি, সাঁকরাইল, ডুবি ভেরীর অহল্যা, বাতাসী, সরোজিনী, উত্তমী, পাঁচুবালা প্রমুখ কম করে ৩৫ জন গরীব কৃষক রমণী। ১৯৪৮ সালের ৬ ই নভেম্বর,পুলিশের গুলিতে নিহিত হন সন্তানসম্ভবা অহল্যা মা– ” সেদিন রাত্রে সারা কাকদ্বীপে হরতাল হয়েছিল..” অহল্যা-মায়ের সেই সন্তান,সেতো কোনদিন আর জন্ম নিল না।

চারিদিকে অধিকারের সংগ্রাম।সাধারণ মানুষ, নারীদের ওপর পুলিশের অত্যাচার,গুলি,শাসকের অত্যাচার বাড়তেই থাকে।
তৈরী হয় “মায়েদের সমিতি”। শাসকের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ,প্রতিরোধ। তারই ফলস্বরূপ সেই ১৯৪৯ সালের এই ২৭ শে এপ্রিল। আজও ২৭ শে এপ্রিল আমাদের কাছে বরণীয় স্মরণীয় দিন।অধিকার রক্ষার উজ্জ্বল প্রতীক।

আজও এদেশের নানান রাজ্যে নারীরা অপমানিত, অত্যাচারিত,সুরক্ষাহীন। ধর্মের নামে চারিদিকে বিভেদমূলক অস্থিরতা। তার শিকার হন আজও অসংখ্য নারীরা।তাই আজ কঠিন শপথ নেবার সময়ে আমাদের মনে রাখতে হবে সেই সেদিনের ২৭ শে এপ্রিলের আকাশ ছোঁয়া স্পর্ধায় নারী সমাজ স্মরণ করবে সেইসব শহীদদের রক্তঋণ। তাই লক্ষ কোটি তারার বিনিদ্র চোখে আমরা রয়েছি জেগে,জাগিয়ে রেখেছি আমাদের,জেগে আছে ১৯৪৯ এর সেই ২৭ শে এপ্রিল–পোহায়,রজনী, জাগিছে জননী, ঘরে ঘরে,সমাজের প্রতিটি স্তরে।

তারা জানে কোন জাতপাত কিংবা জাতধর্ম নয়,সহিষ্ণুতাই আমাদের একমাত্র পরিচয়। স্মরণীয় বরণীয় সেই নারীদের চরণ ছুঁয়ে যাই বিনম্র শ্রদ্ধায়।

২৭ শে এপ্রিলকে মনে রেখে, প্রাণের আসনে বসিয়ে।

Related posts

আমাদের দেশ, আমাদের দ্বেষ-বিদ্বেষ এবং রবীন্দ্রনাথ

কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর, সে-দেহে তাহার কোন প্রমাণ ছিল না

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী