প্রথম পাতা প্রবন্ধ শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া একটি কবিতার ইতিহাস

শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া একটি কবিতার ইতিহাস

27 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই পঙক্তিগুলি যেন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এই লেখার কথামুখের জন্য–“আজি হতে শতবর্ষ পরে,কে তুমি পড়িছ বসি,আমার কবিতাখানি কৌতূহল ভরে..”।

সত্যি,আজও প্রাঞ্জল সেই কবিতা, যা নিয়ে আজকের কিছু কথা। ১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারী সেই সময়ের বাংলা পত্র-পত্রিকার জগতে অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা “সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকাতে (যার সাথে যুক্ত ছিলেন শ্রী অরবিন্দ -এর ভাই বিপ্লবী বারীন ঘোষ।আর সেই সময়ের পত্রিকা সম্পাদক ছিলেন বিপ্লবী নলিনীকান্ত সরকার) প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী” কবিতাটি। পরে অবশ্য আরও অন্যান্য পত্রিকায় এই কবিতাটি জনমানসের দাবীতে প্রকাশিত হয়েছিল। যেমন, “মোসলেম ভারত “, ” ধূমকেতু”, “প্রবাসী”, ” মাসিক বসুমতী” এবং ” সাধনা” পত্রিকাতে।

কাজী নজরুল ইসলামের এই বিদ্রোহী কবিতার একটি ইতিহাস আছে। এই ধরনের কবিতা বাংলা কাব্য ও সাহিত্য জগতের ইতিহাসে প্রথমনজির সৃষ্টি করেছিল এই “বিদ্রোহী” কবিতাটি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ৩৯ বেঙ্গলী ব্যাটেলিয়ন (করাচী) শাখায় যুক্ত সেনানীদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।কাজী নজরুল যেহেতু এই সেনা বাহিনীতেই ছিলেন, তাই তিনিও তখন করাচী থেকে কুমিল্লা, যশোর (এখন বাংলাদেশের) হয়ে কলকাতাতে চলে আসেন জীবন জীবিকার সন্ধানে। কলকাতায় এসে বিভিন্নস্থানে কয়েকদিন থাকার পরে সবশেষে বন্ধু মুজফফর আহমেদের সঙ্গে কলকাতার ৮ নম্বর সদর স্ট্রীটের পেছনে ৩/৪,সি তালতলা লেনের একটি ভাড়াবাড়িতে নিচের তলায় দক্ষিণ পূর্ব কোনের ঘরে থাকতে শুরু করেন।
মুজফফর আহমেদ ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির এবং সেই যুগের জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের নেতা এবং “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা”-র প্রাণপুরুষ। নজরুলের তখন ২২ বছর বয়স।

যাইহোক, নজরুল সেই ৩/৪,সি তালতলা লেনের বাড়িতে তার স্বভাবসিদ্ধ প্রাণখোলা স্বভাবে তৈরী করছেন বিভিন্ন ধরনের গান,লিখছেন কবিতা। অনেকসময় যার প্রথম ও একমাত্র শ্রোতা বন্ধুবর মুজফফর আহমেদ। সেই মুজফফর আহমেদ পরবর্তী সময়ে লেখা তাঁর আত্মকথায় (কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা) লিখছেন:-
” তখন আমি আর নজরুল নিচের তলায় থাকি। সে “বিদ্রোহী” কবিতাটি লিখেছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের এক রাত্রিতে। রোজের মতো সেদিনও রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যথারীতি পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ হাতপা ধুয়ে ঘরে এসে আমি বসেছি,এমন সময়ে নজরুল এসে বলল,সে একটা কবিতা লিখেছে।পুরো কবিতাটি সে তখন পড়ে আমায় শোনালো।”

তিনি আরও লিখেছেন :-” ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।পরে জেনেছিলাম,নজরুল মাঝরাতে উঠে,কবিতাটি লিখেছিল।ঘরে একটা লন্ঠন অল্প আলো নিয়ে জ্বলত।সেটা নিয়ে সে ঘরের মেঝেতে বসে লিখেছিল পুরো কবিতাটি। তা না হলে অত সকালে সে আমাকে সেই কবিতা পড়ে শোনাতে পারতো না।”

১৯৬৫ সালে লেখা মুজফফর আহমেদের সেই স্মৃতিকথায় তিনি লিখছেন-“এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুলের বা আমার কাছে ফাউন্টেন পেন ছিলনা। দোয়াতে বারবার কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তাল রাখতে পারবে না,এই ভেবেই সে কবিতাটি আগাগোড়া পেন্সিলে লিখেছিল।”

এরপরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি।সারাবিশ্বে এমন কোনও বাঙালী নেই,যিনি এই কবিতাটি পড়েননি,বা শোনেন নি।

নজরুল এই কবিতা ১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারী “বিজলী” পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পরেই নিজে ছুটে গিয়েছিলেন কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে নজরুল ইসলামের প্রিয় মানুষ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে।তিনি স্বকন্ঠে সেদিন বিশ্বকবিকে “বিদ্রোহী ” কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান।তারপর সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কে।সেদিন কবিগুরুও পুত্রসম কাজী নজরুল ইসলামকে বুকে জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন,”বাঙালীর কাব্য সাহিত্য আকাশে আজ এক ধুমকেতুর সৃষ্টি হলো।বাংলা সাহিত্য কাব্য জগৎ তোমার অপেক্ষাতেই ছিল।”

“বিদ্রোহী” কবিতার মোট পঙক্তি সংখ্যা হল ১৩৯। সাপ্তাহিক “বিজলী” পত্রিকাতে ১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারী কবিতাটি প্রকাশ হবার পরে মানুষের চাহিদার দাবীতেই সেই সপ্তাহেই পত্রিকাটি চার বার ছাপতে হয়েছিল। মুজফফর আহমেদের লেখা থেকে জানা যায় যে ১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারী কবিতাটি প্রকাশ হবার পরে সেই সপ্তাহে অন্ততঃ কবিতাটি ৪/৫ লক্ষ মানুষ পড়েছিলেন।

“বিদ্রোহী” কবিতাটি পরে ইংরেজি ভাষায়,স্প্যানিশ ভাষায় এবং ফরাসী ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এই কবিতাটি সেই যুগের জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার আন্দোলনের অন্যতম বীজমন্ত্র হিসাবেও ইতিহাসে লেখা থাকবে। সারা পৃথিবীতে আজও মানুষের ন্যায্য দাবী এবং মানবাধিকার আন্দোলনে এই “বিদ্রোহী” কবিতাটি বিভিন্ন আঙ্গিকে অনুপ্রেরণা দেয়। সেই বলিষ্ঠ ও ঋজুতায়,তেজস্বীতায় আর ওজস্বীতায় উচ্চারিত:-” বল বীর / বল উন্নত মম শির/ শির নেহারি আমারই নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রীর / বল বীর, চির উন্নত মম শির।”

তারপর শেষের সেই উচ্চারিত ঘোষণা :- “মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেইদিন হবো শান্ত,/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বণিবে না,/ অত্যাচারীর খড়্গ-কৃপাণ ভীম-রণভূমে রণিবে না,/বিদ্রোহী রণক্লান্ত,/ আমি সেইদিন হবো শান্ত…”।

কাজী নজরুল ইসলামের এই “বিদ্রোহী” কবিতার শব্দ চয়ন,তার বলিষ্ঠতায় আমরা খুঁজে পাই আমাদের দেশের এবং এই বিশ্বের আর এক তেজস্বী ওজস্বী মহাপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ-এর আহ্বানের বলিষ্ঠতা। কারন সেই সময়ের বাতাবরণে, এমনকি আজও এবং আগামীতেও স্বামী বিবেকানন্দ এক নবচেতনার মহা-ঋত্বিক,
মহা-পথিকৃৎ। হয়তো অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সেই অনুপ্রেরণার অগ্নিস্ফুলিঙ্গই হলো কাজী নজরুল ইসলামের এই “বিদ্রোহী” কবিতার সৃষ্টির পটভুমিকা।

শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া একটি কবিতার ইতিহাস আমাদের বাংলা ভাষার এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্য। যা আমাদের গৌরবান্বিত করে।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.