পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
বেশ কয়েকবছর ধরেই খবর থেকে জানতে পারছিলাম আমরা,যে আমাদের দেশের একটি ছোট্ট পাহাড়ি রাজ্য, মণিপুরের মাটি হিংসা-প্রতিহিংসার রক্তে ভিজে উঠেছে বারবার। আগুনে ভষ্মীভূত হয়েছে ঘরবাড়ি, লাঞ্ছিতা, ধর্ষিতা হয়েছেন পরস্পর দুটি সম্প্রদায়ের নারীরা। খুন হয়েছেন পুরুষরা। মণিপুরের মেইতেই এবং কুকি সম্প্রদায়ের মানুষ পারস্পরিক বিবাদে ভীষণভাবেই জর্জরিত। এহেন অবস্থাতে একটি মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা আমাদের এক চরম শিক্ষা দিয়ে গেল–কী প্রয়োজন হিংসার? কী প্রয়োজন পারস্পরিক দ্বন্দ্বের?
বৃহস্পতিবার দুপুরে অহমদাবাদ- লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান অসংখ্য মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আছড়ে পড়েছিল উড়ানের অব্যবহিত পরেই,কয়েক মিনিটের মধ্যে অহমদাবাদের জনবহুল এলাকায়।
সেই বিমানেই এয়ারহোস্টেস হিসাবে ছিলেন মণিপুরের মেইতেই সম্প্রদায়ের ২০ বছরের নানথোই শর্মা কোংব্রাইলাতপাম্ আর মণিপুরেরই কুকি সম্প্রদায়ের ২৫ বছরের লালনুনথিয়েম সিংসন্। বিমানে ওঠার মুহূর্তেই একসাথে তারা হাসিমুখে সেলফি তুলেছিল,–
পাঠিয়েছিল তাদের বাড়ির লোকেদের, বন্ধুদের কাছে।সোস্যাল মিডিয়ায় সেই ছবি দেখে দুটি বিবদমান সম্প্রদায়ের মানুষরা খুশী হয়েছিলেন কি’না জানি না। কারণ, হিংসা-প্রতিহিংসা মানুষকে অনেক সময়ে অমানবিক করে তোলে। কিন্তু বাস্তবে উড়ানের কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘটে যাওয়া সেই দুর্ঘটনার খবরে নিশ্চিতভাবেই সেই দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মণিপুর উপত্যকায় বুকফাটা কান্নার রোল উঠেছিল–কারণ, চোখের জলের মধ্যে কোনও বিভেদ নেই, বিবাদ নেই। বিবদমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষই সেদিন কেঁদেছিলেন।সেই চোখের জলে ভিজে উঠেছে হয়তো মানুষের হৃদয়ের অনুভূতি। সেই কুকি আর মেইতেই সম্প্রদায়ের দুই হাসিখুশি তরুণী আর নেই,–পড়ে আছে তাদের হাসিমুখের একসাথে তোলা সেই শেষ ছবিটি –আর তাদের ঝলসে যাওয়া, ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া আগুনে পোড়া নিথর নিষ্প্রাণ দুটি মৃতদেহ।
তাহলে? কি নিয়ে বাঁচবো আমরা? হিংসা? বিবাদ? বিভেদ? নাকি বাঁচবো পারস্পরিক সহিষ্ণুতা, মনুষ্যত্ব, আর ভালোবাসা নিয়ে? জিজ্ঞাসাগুলো বড্ড নির্মমতায় আজ সামনে এসে দাঁড়ায় নীরবে,নিষ্পলকে।
প্রতীক জোশি, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, গত ৬ বছর ধরে লন্ডনে থাকেন। অনেক দিনের স্বপ্ন,লন্ডনে থিতু হয়ে স্ত্রী এবং তিন সন্তানকে নিয়ে যাবেন সেখানে এবং তারা একসাথে থাকবেন সেখানে। সেইমতন সব বন্দোবস্তও পাকা।প্রতীকের স্ত্রী ডাক্তার কোমি ব্যাস এদেশে তার চাকরি ছেড়ে দিয়ে সন্তানদের নিয়ে ওদেশে পাকাপাকিভাবে থাকবার জন্য সব গোছগাছ করে,বৃহস্পতিবার সকালে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে উঠবেন।ওঠার আগে প্রতীক স্ত্রীকে আর সন্তানদের নিয়ে তুললেন সেলফি।ছড়িয়ে দিলেন সকলের হাসিমুখের সেই ছবিগুলি সোস্যাল মিডিয়াতে। দেশে বিদেশে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের কাছে পৌঁছেও গেল,সেইসব ছবিগুলি। কিন্তু কে জানতো?–সেটাই তাদের শেষ ছবি।শেষ সেলফি!!
না–তারা কেউ বেঁচে নেই আর।কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই একটি পরিবার,অনেক অনেক স্বপ্ন,মুঠোমুঠো অসংখ্য ইচ্ছেগুলো পুড়ে ছারখার হয়ে গেল,মানুষগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়লো শুধু আগুনে দগ্ধ হয়ে,পোড়া মুঠো মুঠো কালো ছাই হয়ে। কথায় বলে, Man proposes,God disposes,–মানুষ ভাবে এক, আর নিয়তি ঘটায় আর এক।
অহমদাবাদের বিজে মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে বিরাট হলঘরে তখন দুপুরের খাওয়া দাওয়া করছিল হোস্টেলের পড়ুয়ারা। কেউ কেউ বিশ্রাম নিচ্ছিল,কেউবা পড়ছিল,–হঠাৎ সেই হোস্টেলেই আছড়ে পড়েছিল দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটি। তার বিকট আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ, চারিদিকে আগুন আর আগুন। কয়েক সেকেন্ডে অনেক পড়ুয়া এক নিমেষে হয়ে গেল মৃতদেহ। তারা জানতেই পারল না ব্যাপারটা কি হোল? অনেকগুলো পরিবারের প্রিয় সন্তান অকালেই চলে গেল মরনের পারে।আশেপাশের বাড়িগুলোও ঝলসে গেল।সে এক ভয়ানক বীভৎস রকমের অবস্থা।
বোধহয় এই জন্যেই বলে জীবনের আরেক নাম পদ্মপাতায় জল–এই আছে এই নেই। তাই অহমিকা নয়, স্বার্থপরতা নয়, জীবনকে ভালবেসে,সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকাটাই হোক আমাদের কাম্য।
এরই মধ্যে অলৌকিকভাবেই জীবিত রয়েছেন ঐ বিমানের একমাত্র যাত্রী লন্ডন প্রবাসী ৩৮ বছরের বিশ্বকুমার রমেশ। রাখে হরি মারে কে? তিনি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন তাঁর জীবনের অধিদেবতাকে।
কিন্তু এই ঘটনা আমাদের কাছে প্রশ্ন রেখে যায়,যে উড়ানের আগে বিমানটির সমস্ত যান্ত্রিক ব্যবস্থা যথাযথভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কি উড়ানের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল? যদি তা না হয়ে থাকে,তাহলে এতোগুলা মানুষের জীবন নিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য দায়ী কে বা কারা? যাত্রী সুরক্ষার পরিষেবা কি তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বস্তু? এই ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত হোক।হোক দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা।সেখানে কোনও রকমের শিথিলতা যেন না থাকে।
অকালে যারা চলে গেলেন,তাদের সকলের প্রতি রইল আমাদের শ্রদ্ধা।আর তাদের বিপর্যস্ত পরিবারগুলির প্রতি রইল আমাদের সহমর্মিতা, সমানুভূতি। তাদের ঘরের মানুষ আর কোনওদিনই ফিরবে না তাদের কাছে।তাদের মনের মণিকোঠায় রয়ে যাবে স্মৃতি আর সেই ফেলে আসা দিনগুলির জন্যে একরাশ হাহাকার,কষ্ট,এবং চোখের জল।
“Time marches on,but memory stays,/It silently torture rest of our days.” (Lord Tennyson)
“স্মৃতি তুমি বেদনার,/ আজিও কাঁদিছে হারানো স্বপন হৃদয়েরও বেদীকায়…”