পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
২৩ মার্চ। প্রতি বছর ক্যালেন্ডারের পাতায় আসে, চলে যায়।দশকের পর দশক এভাবেই আসে আর যায় ২৩ মার্চ। আর পাঁচটা দিনের মতো। আমরা গড্ডলিকা প্রবাহে দিন কাটাই,জীবন যাপন করি। নিজেদের নিয়ে ব্যস্ততায় ভুলে যাই আমরা অনেক কিছু। মনেই রাখি না।আসলে আমাদের মনে রাখতে দেওয়া হয় না। কারণ, আমাদের সেইভাবে জানানো হয়নি, ভাবানো হয়নি আমাদের অতীত ঐতিহ্য, আমাদের ইতিহাস, আমাদের পরম্পরাকে।
আসলে আমাদের পূর্বপ্রজন্ম সহ আমরা বড্ড বেশি কর্তাভজা। বড্ড বেশি দাসত্বের বশংবদতায় নিজেরা নিমজ্জিত। আমাদের শিরদাঁড়া নিয়ে আমরা সন্দেহাতীত নই। তাই আমরা আমাদের অতীত নিয়ে আমরা আত্মবিস্মৃত হয়েই মত্ত হয়ে রই।
আর ৫ বছর পরে ২০৩০ সালে আমাদের দেশের যে ঐতিহাসিক ঘটনার শতবছর উদযাপন শুরু হবে,সেই ইতিহাসটা আমরা জানিই না।মনেই রাখিনি হয়তো।
১৯৩১ সাল। আজকের দিনে,এই ২৩ শে মার্চ, সন্ধ্যে ৭/৭.৩০ টায় অখণ্ড ভারতবর্ষের লাহোরের জেলে একসাথে তিন বিপ্লবী, ভারতমায়ের বীর সন্তানকে নৃশংসভাবে ফাঁসির মঞ্চে তখনকার ব্রিটিশ সরকার এক প্রহসনের বিচার শেষে ফাঁসি দিয়ে খুন করেছিল।তারপর, তাদের নিথর,প্রাণহীন দেহগুলিকে টুকরো টুকরো করে কেটে,বস্তার ভেতরে পুরে,রাতের অন্ধকারে আবর্জনা ফেলার ট্রাকে করে লাহোর সেন্ট্রাল জেলের বাইরে এনে সেখান থেকে প্রায় দু’ঘন্টার পথের দূরত্বে একটি জায়গা, নাম কাসুর,সেই কাসুরের কাছে শতদ্রু নদীর কাছে নিয়ে গিয়ে সেই তরতাজা তিন মহাবিপ্লবী,দেশপ্রেমিক, ভারতমাতার তিন বীর সন্তানের ফাঁসীর পরে মৃতদেহগুলিকে করাত দিয়ে কেটে খন্ড খন্ড করে পুরে রাখা বস্তাগুলো নামিয়ে,তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ভোরের আলো ফুটছে দেখে আধপোড়া অবস্থায় ফেলে ব্রিটিশ অফিসাররা সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিল।মৃত মানুষের প্রতি ন্যূনতম সম্মানটুকুও সেদিন তারা জানায়নি। তারপর নদীর আশেপাশের গ্রামে থাকা গরীব মানুষের চোখে পড়ে ঘটিনাটি,এবং তারা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে একজায়গাতে সমবেত হয়ে পূর্ণ মর্যাদায় সেই তিন শহীদের মৃতদেহগুলি যথাযথভাবে সম্মানের সাথে অন্তিম সৎকার করেছিলেন সেদিন।
না,–সেদিন এই শহীদদের দেহগুলি পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার সৌজন্যতাও দেখায়নি ব্রিটিশ সরকার।
এই তিনজন শহীদের সাথে এই রকম জঘন্যতম অপরাধযোগ্য, অমানবিক কাজের জন্য সেদিন দেশের কোনও নেতা নেত্রী প্রতিবাদ করেনি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে। না গান্ধী, না নেহরু,না প্যটেল,না রাজাগোপালাচারি, প্রমুখরা। একমাত্র নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছাড়া। তিনি এই ঘটনা জানতে পারার পরে প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। নেতাদের সাথে মতভেদ হয় প্রচন্ডভাবে। তারপর সেই অকুস্থানে গিয়ে, ঐ নদীর ধারের সেই ঐতিহাসিক স্থানে দেশের পতাকা তুলেছিলেন,সেই মৃত্যুঞ্জয়ী তিন শহীদদের স্মরণ করে।সারা আকাশ বাতাস মুখরিত হয়েছিল “বন্দেমাতরম “, “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” সহস্র সহস্র সমবেত কণ্ঠের শ্লোগানে। সেই ঘটনা তিনি ঘটিয়েছিলেন এক ভোর রাতে।হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিল সেদিন।
তিনিই প্রথম সেই তিনজন শহীদের স্মৃতিতে দিনটি “শহীদ দিবস” হিসাবে স্মরন করার আহ্বান জানান সেদিন সারা দেশবাসীর কাছে। তাই ২৩ শে মার্চ “শহীদ দিবস”।
কিন্তু আমরা মনেই রাখিনি এই দিনটির ইতিহাসকে। আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।আমাদের ইতিহাসের বইতে স্থান পায়নি এই ঐতিহাসিক ঘটনার ইতিহাস। এটাই এক ষড়যন্ত্র।
সেই তিনজন বীর বিপ্লবী দেশপ্রেমিক হলেন–
শহীদ-ই-আজম ” ভগৎ সিং।”
(জন্ম-২৮.৯.১৯০৭// শহীদের মৃত্যু- ২৩.৩.১৯৩১// মায়ের নাম বিদ্যবতী দেবী।বাবার নাম- সর্দার কিষান সিং সান্ধু// জন্মস্থান–বাঙ্গা,পশ্চিম পঞ্জাব/এখন পাকিস্তানে)।
শহীদ- ই -আজম
” শিবরাম রাজগুরু”
(জন্ম-২৪.৮.১৯০৮// শহীদের মৃত্যু-২৩.৩.১৯৩১/
মায়ের নাম- পার্ব্বতী বাঈ,/ বাবার নাম- হরিনারায়ণ রাজগুরু।// জন্মস্থান-রাজগুরু নগর,খেড়্,মুম্বাই,
মহারাষ্ট্র)।
শহীদ -ই -আজম
” শুকদেব থাপার”
(জন্ম- ১৫.৫.১৯০৭// শহীদের মৃত্যু- ২৩.৩.১৯৩১/ মায়ের না – যমুনা দেবী/ বাবার নাম- রামলাল থাপার। জন্মস্থান – লুধিয়ানা, পাঞ্জাব)।
আজ এই শহীদ দিবসে আমাদের প্রণাম রইল এই তিন
শহীদ-ই- আজম এর প্রতি।
“ওরা আকাশের আগুন পাখি,ওরা আকাশের উদ্দাম ঝড়,
ওরা ভাই বেরাদর তোমারই আমারই, ওগো জন্মভূমি, ওগো মাতৃভুমি,ওদের ঋণ কোনওদিন কি শোধ করতে পারি?
ওদের কোনও দিন ভুলতে কি পারি?”
(অমৃতাশ্ব)