২৫ শে ডিসেম্বর বড়দিন…সান্টা ক্লজ্ এবং কিছু কথা

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

আমাদের বাংলায় তো বটেই, সারা ভারতবর্ষে,সারা বিশ্বে প্রতি বছর এক ঐতিহ্য-পরম্পরা-র মত পালিত হয় ঘরে ঘরে, মহল্লায় মহল্লায় ২৫ শে ডিসেম্বর…যার আর এক নাম বড়দিন।

এই বড়দিনের প্রাণপুরুষ হলেন যীশু খ্রীস্ট।এই মহাপুরুষের জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই সারা বিশ্বে ২৫ শে ডিসেম্বর প্রায় প্রতিটি দেশেই সাধারণ মানুষের মধ্যে বড়দিনের উৎসব পালন করার আকর্ষণ উদ্দীপনা দেখা যায়।

যীশু খ্রীস্টের ক্রুশবিদ্ধকরণের পরে ৩৩৬ খ্রীস্টাব্দে রোমান ক্যাথলিক সম্রাট কনস্টান্টাইন প্রথম ২৫ শে ডিসেম্বরের দিন বড়দিন পালন করা শুরু করেছিলেন। এরপরই ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে এই উৎসব পালিত হতে থাকে।এবং সেই উৎসব পালনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন পোপ জুলিয়াস।

আমাদের ভারতবর্ষে তথা এই বাংলাতে প্রথম বড়দিন পালন করেন ১৬৬৮ খ্রীস্টাব্দে (মানে কলকাতা নগরীর পত্তনের ২২ বছর আগে) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জব চার্নক।

বড়দিনের উৎসব পালন করতে গিয়ে আমরা বড়দিনের দিন কেক কাটি,খ্রিসমাস ট্রি লাগাই,জিংগল বেল লাগানো হয়,খ্রিসমাস টুপি পড়ে শিশুরা, ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে কতো আনন্দ উদযাপন করা হয়। তারই মধ্যে শৈশবের একটি স্মৃতি প্রায় সকলেরই আছে, আর সেটা হোল “সান্তা ক্লজ”-এর উপহার ছোটদের জন্য। কি দারুণ মজার আনন্দ সেটা।

এই সান্টা ক্লজের ইতিহাস সেণ্ট নিকোলাসের জীবনের সাথে জড়িত। ২৮০ খ্রীষ্টাব্দে রোমের মাইরা-তে নিকোলাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক ধনী পরিবারে।কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার যে শৈশবেই তিনি তাঁর মা-বাবাকে হারান। বাবা-মা হারা নিকোলাস ছোটবেলা থেকেই যীশু খ্রীস্ট-এর প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠেন। পরে তিনি যীশুর বানী প্রচারের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। আশেপাশের মানুষের সাথে ছিল তাঁর অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্ক। পরহিতের জন্য তিনি সদা সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। নিজে যেহেতু শৈশবে অনাথ হয়ে গিয়েছিলেন,তাই তিনি অনাথ,গরীব শিশুদের দুঃখ কষ্ট অনুভব করতেন এবং তাদের এই উৎসব উপলক্ষ্যে উপহার সামগ্রী দিয়ে বেড়াতেন এই বড়দিনের আগের দিন ২৪ শে ডিসেম্বরের রাতে। আশেপাশের মানুষজন নিকোলাসকে ” সেন্ট নিকোলাস ” বলে সম্বোধন করতো।

এই সেন্ট নিকোলাস প্রতি ২৪ শে ডিসেম্বর রাতে কখনো লাল,কখনো সাদা,কখনো বাদামী রঙের পোষাক পরে রাতের অন্ধকারে গরীব,অনাথ শিশুদের আস্তানায় গিয়ে ঘুরে ঘুরে উপহারগুলি রেখে আসতেন।আর পরের দিন ভোরে,সকালে শিশুরা সেইসব উপহার পেয়ে খুব খুশী হতো। পরে কেউ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন উপহারগুলো দিয়ে গেছে “সেন্ট কোলাস” (নিজের নাম থেকে ছোট করে,পরে সেই সেন্ট কোলাস থেকেই “সান্টা ক্লস” শব্দটা এসেছে)।

সান্টা ক্লজের যে ছবিগুলি আমরা দেখি,সেই লাল পোষাকে সান্টা ক্লজ-কে ১৬২৬ সালে হারপার উইকলি নামে একটি পত্রিকার জন্য এঁকেছিলেন শিল্পী টমাস নাস্ট (Thomas Nust)। পরে ১৯৩১ সালেও আমেরিকাতে কোকাকোলা-র একটি বিজ্ঞাপনের জন্যও টমাস নাস্ট লাল পোষাক পরা সান্টা ক্লজ এঁকেছিলেন,আবার সবুজ পোষাক পরা সান্টা ক্লজ-ও এঁকেছিলেন।

বেথহেলেমের এক আস্তাবলে ২৪ শে ডিসেম্বরের মধ্যরাত্রে যে ঐশ্বরিক শিশুটি আজ থেকে প্রায় দু হাজার বছর আগে জন্মেছিলেন মানুষের সুখ দুঃখের একান্ত আপন দোসর হওয়ার ঐতিহাসিক প্রয়োজনে,যাকে মানুষের সমস্ত রকমের অন্যায়,অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল মুখবুজে,যিনি নিজের মৃত্যুদন্ডের ক্রুশ নিজেই বহন করেছিলেন,কোন মানবিকতা, সহানুভুতি সেদিন তিনি পাননি,বরঞ্চ পেয়েছিলেন অপমান,অবজ্ঞা,
গালিগালাজ, গায়ে থুৎকার ইত্যাদি ইত্যাদি, সেই ঈশ্বরের সন্তান,যাকে একদিন রাজার দোহাই দিয়ে এই মানুষরা হত্যা করেছিল,অন্তিম সময়েও যিনি সেই অপরাধীদের জন্য,অমানবিকদের জন্য বিনম্রতায় পরম প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন,সেই মহামহিম যীশুর পবিত্র আবির্ভাবের পুণ্যতিথিতে রইল অসংখ্য প্রনাম।

আর রইল আমাদের সহ নাগরিকদের জন্য বড়দিনের আন্তরিক শুভেচ্ছা,অভিনন্দন এবং ভালোবাসা।

সকলে আনন্দে থাকুন,ভালো থাকুন।

Related posts

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

চৈত্র বৈশাখ মধুমাধবের মায়ায় মায়ায়