জেনে নিন ভারতীয় সংবিধানের এক অজানা ইতিহাস

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার দু’বছর পরে ১৯৪৯ সালে এক ইতিহাসের জন্ম হয়েছিল,যা কিন্তু আমরা জানিই না। সেই অজানা ইতিহাসের কথাই আজ জানবো।

আমরা সকলেই জানি যে,আমাদের ভারতবর্ষের  সংবিধানের জনক হলেন ডক্টর বি.আর.আম্বেদকার। কিন্তু আমরা ক’জন জানি যে এই সুবিশাল সংবিধানটি সর্বপ্রথমে লেখা হয়েছিল সম্পূর্ণ একজন মানুষের হাতের লেখাতে। এই সংবিধানটি লেখার জন্য কোনও প্রকারের যন্ত্রেরও সেদিন ব্যবহার করা হয়নি। সম্পূর্ণ এই সংবিধানটি মানে পুরো বইটিই নিজের হাতে ইটালিক স্টাইলে ক্যালিগ্রাফি করে লিখেছিলেন এক প্রতিভাবান মানুষ, যার নাম প্রেমবিহারী নারায়ণ রায়জাদা সাক্সেনা।

সেইযুগের ভারতবর্ষে প্রেমবিহারী ছিলেন একজন নামজাদা সুন্দর হস্তাক্ষরের এবং ক্যালিগ্রাফিতে প্রতিভাবান কুশলী ও দক্ষ মানুষ।

১৯০১ সালের ১৭ ই ডিসেম্বর দিল্লিতে প্রেমবিহারী জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতামহ রামপ্রসাদ সাক্সেনা ছিলেন  সে যুগের একজন গুণী ব্যক্তি। তিনি ছিলেন  ক্যালিগ্রাফার এবং পার্শী ও ইংরেজি ভাষার সু-পণ্ডিত মানুষ।  তিনি তৎকালীন ইংরেজ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের পার্শী ভাষা শেখাতেন। প্রেম বিহারী যখন কিশোর বয়সের, তখন তাঁর বাবা এবং মা মারা যান। তিনি তাই দাদুর কাছেই মানুষ হতে থাকেন। দাদুর স্নেহ যত্নেই তিনি বড়ো হন। আর পেয়েছিলেন কাকা চতুর বিহারী সাক্সেনাকে। দাদু সুন্দর হাতের লেখা তৈরি করারা জন্য ছোটবেলা থেকেই প্রেম বিহারীকে ক্যালিগ্রাফি আর্ট ও স্টাইল শিখিয়েছিলেন। প্রেমবিহারী দিল্লীর সেন্ট স্টিফেন কলেজ থেকে বি.এ.পাশ করার পর দাদুর কাছে শেখা ক্যালিগ্রাফি আর্ট নিয়ে অনুশীলন এবং চর্চা করতে শুরু করেন,এবং এই বিষয়ে একজন কুশলী ও সুদক্ষও হয়ে ওঠেন।

ধীরে ধীরে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। এদিকে ততদিনে দেশের সংবিধানের খসড়া ছাপার জন্য তৈরী হয়ে গেছে। তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল যে সংবিধানটি ছাপার অক্ষরে না হয়ে যদি ইটালিক অক্ষরে ক্যালিগ্রাফি করে লেখা যায়। আর সেই কারণেই খোঁজ খবর নিয়ে তিনি ডেকে পাঠালেন প্রেমবিহারীকে।

মুখোমুখি একদিন বসলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং প্রেমবিহারী সাক্সেনা।

জওহরলাল নেহেরু প্রেমবিহারীকে সংবিধানটি হাতে লিখে দিতে বললেন, এবং তিনি কতো সান্মানিক নেবেন তা জানতে চাইলেন। সেদিন প্রেমবিহারী বলেছিলেন নেহেরু কেঃ”Not a single penny. By the grace of God I have all the things and am quite happy with my life.” এরপর তিনি একটি অনুরোধ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে, ” I have one reservation — that on every page of the constitution I will write my name and on the last page I will write my name along with my Grandfather’s name.” জওহরলাল  নেহেরু এই অনুরোধ মেনে নিয়েছিলেন।

এরপর প্রধানমন্ত্রী  এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের সঙ্গে আলোচনা করে ১৯৪৯ সালের ২৯ শে নভেম্বর তার সঙ্গে প্রেমবিহারী নারায়নণ রায়জাদা সাক্সেনা এসেছিলেন এই বাংলায় কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে। তাঁরা বিখ্যাত চিত্রকর নন্দলাল বসুর সাথে সুদীর্ঘ আলোচনা করেন এবং স্থির হয় কিভাবে,প্রতিটি পাতার কতোটা অংশে প্রেমবিহারী লিখবেন আর প্রতিটি পাতার বাকি ফাঁকা জায়গাতে নন্দলাল বসু অলংকরণ সজ্জিত করবেন।

নন্দলাল বসু অলংকরণ করেন হরপ্পা মহেঞ্জোদারো,  দ্রাবিড় সভ্যতার সিলমোহর, রামায়ণ-মহাভারত, গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর, জরথ্রুস্ট,  নানক, শ্রীচৈতন্য দেব, মীরাবাঈ,প্রমুখদের জীবন, সম্রাট অশোক,চন্দ্রগুপ্ত,চাণক্য,বিক্রমাদিত্য, কণিষ্ক,হর্ষবর্ধন প্রমুখদের কাহিনী, সম্রাট আকবর ও মুঘল সাম্রাজ্য,রানা প্রতাপ,শিবাজী, সিপাহী বিদ্রোহ,লক্ষীবাঈ,টিপু সুলতান,শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামী বিবেকানন্দের কথা, রবীন্দ্রনাথের কথা,গান্ধীজির আন্দোলন,নেতাজী সুভাষচন্দ্র এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াই, ভারতের নদী,পাহাড়, অরণ্য, মরুভুমি,পশু পাখী ইত্যাদির সৌন্দর্য রূপচিত্রের অঙ্কনে,অলংকরণে ফুটিয়ে তুলেছেন।

এ যেন আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাস আর ভুগোলের চিত্রিত রূপ-রাজির নকশীকাঁথা। সংবিধানের বিষয়বস্তু  এবং অনুচ্ছেদ অনুসারে খুবই সুচিন্তিতভাবে চিত্র কল্পগুলি তাঁরা অলংকৃত করেছিলেন।

এই সংবিধান লেখার জন্য প্রেমবিহারী বাবু একটি ঘরে বসে প্রায় ছ’মাস ধরে কাজ করেছিলেন। তাঁর প্রয়োজন হয়েছিল ৪০২ টি পেন হোল্ডার,তিনি ৩০৩ নম্বরের পেনের নিব ব্যবহার করেছিলেন।সেই নিবগুলি নিয়ে আসা হয়েছিল ইংল্যান্ড এবং চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে।

সংবিধানটি লিখতে ২৫১ টি পার্চমেন্ট পেপার ব্যবহার করা হয়েছে। সংবিধানটির ওজন ৩ কিলো ৭৫০ গ্রাম।সংবিধানের দৈর্ঘ্যের বহর ২২ ইঞ্চি,আর প্রস্তের বহর ১৬ ইঞ্চি।

ভারতীয় এই সংবিধানটি বর্তমানে দিল্লীর সংসদ ভবনের গ্রন্থাগারে অতি সযত্নে সংরক্ষিত করে রাখা আছে।

প্রেমবিহারী নারায়ণ ১৯৬৬ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারী মারা যান। আর নন্দলাল বসু মারা যান ঐ একই বছর ১৯৬৬ সালের ১৬ ই এপ্রিল। আমাদের দেশের সংবিধান হাতে লেখা এবং অলংকরণ করার জন্য দুজনের কেউই কোন সান্মানিক নেননি।

Related posts

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

চৈত্র বৈশাখ মধুমাধবের মায়ায় মায়ায়