পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
মানবসভ্যতার ইতিহাসে জানা যায়,রক্তহীনতায়,রক্তাল্পতায় এককালে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ আমাদের এই বিশ্বে মারা যেত অকালে।বিশেষ করে মহিলা, শিশু আর বয়স্করা এবং দুর্ঘটনায় পতিত মানুষরা। সেইসব মৃত্যুর প্রধান ও একমাত্র কারন ছিল রক্তের জোগান না থাকা।
এই সমস্যা গত শতকের মাঝামাঝি অবধি ছিল এই সভ্যতার এক অসহায় অবস্থায়। যার প্রতিকার ছিল একমাত্র রোগীকে প্রত্যক্ষভাবে রোগীর আত্মীয়- স্বজনদের দ্বারা রক্তদান করার মাধ্যম।
বিভিন্নভাবে সমাজতত্ত্ববিদরা অনেক ভাবনাচিন্তার পরে,এবং বিজ্ঞানের মেডিকেল ও প্যাথলজিক্যাল সেক্টরে অত্যন্ত অগ্রগতি এবং উন্নতি স্বরূপ বিভিন্নধরনের সরঞ্জাম,পদ্ধতি ইত্যাদি ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে বিভিন্নদেশে রক্তদানের পদ্ধতি সহ সামাজিক সচেতনতা ধীরে ধীরে শুরু হয়,এবং তা পরে বৃদ্ধিও পেতে থাকে।মানুষের অভিজ্ঞতা জন্ম নিতে থাকে।যদিও প্রাথমিকভাবে শুরুতে সমাজের বিভিন্ন স্তরে নানারকমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল।নানা প্রকারের কুসংস্কারাচ্ছন্নতা রক্তদানের মতো পবিত্র মহান কাজকে বাধাপ্রাপ্ত করেছিল।তবুও দেশে দেশে সমাজ সচেতন মানুষ এই রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা এবং সেই বিষয়ে আশু কর্তব্য হিসাবে গ্রহন করে। সভ্যতার উপকার হয়,রক্তদানের ব্যাপারে সমস্ত স্তরের মানুষ উদ্যোগ নিতে শুরু করেছিলেন।
গত শতকের নব্বইয়ের মাঝামাঝি,১৯৯৫ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation / WHO) ১৪ ই জুন তারিখের দিনটিকে আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস হিসাবে পালন করার প্রস্তাব গ্রহন করে,এবং, দেশে দেশে মানুষের মধ্যে,বিভিন্ন সামাজিক এবং সরকারী বেসরকারী সংস্থাগুলির মধ্যে রক্তদানের প্রয়োজনীয়তার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির নানারকমের ধারাবাহিক কর্মসূচী গ্রহনের উদ্যোগ গ্রহন করেন। পরে UNESCO এবং WHO সম্মিলিতভাবে ২০০৪ সালের ১৪ ই জুন তারিখটিকে আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস হিসাবে স্মরণে রেখেই সারা বিশ্বের সমস্ত দেশেই পালন করার জন্য এই বিশ্বের সমস্ত দেশেই অবশ্যই করনীয় হিসাবে আর মানুষকে রক্তদানের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল করে।
প্রতি বছরে সারা পৃথিবীতে ১৮২ // ১৮৩ কোটি ইউনিট রক্ত সংগৃহীত হয় রক্তদানের মাধ্যমে। এই সংখ্যক ইউনিটের প্রায় ৩৮/৪০ শতাংশ রক্ত সংগৃহীত হয় আমাদের ভারতবর্ষের মতো বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের থেকে। পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে যা প্রায় ৩৮% শতাংশ। যেখানে সারা বিশ্বের জনসংখ্যার ৮২/৮৩ শতাংশ মানুষ বসবাস করে।
এই ১৪ ই জুন তারিখটা কেন আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস হিসাবে পালন করার কথা ভাবা হল। এখানে উল্লেখ্য যে মানুষের রক্তের গ্রুপ আবিষ্কার করেছিলেন মেডিকেল সায়েন্স এর একজন বিশ্ববন্দিত নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডাক্তার মিস্টার কার্ল লান্ডস্টাইনারের জন্মদিন।
এই মহাবিজ্ঞানী কার্ল লান্ডস্টাইন যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছিলেন মানুষের রক্তের গ্রুপ— A, B, AB, O.। এই বিজ্ঞানীর জন্মদিনকে স্মরনীয় করে রাখার জন্যই প্রতি বছর ১৪ ই জুন আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস পালন করা হয়।
রক্তদান করা সবচেয়ে মহান এক সামাজিক কাজ। কারন,আমরা জানি যে, রক্তদানের মাধ্যমে আমি আপনি একটি মুমূর্ষু মানুষের প্রাণ বাঁচাবো।বাঁচবে একজন মানুষ, বাঁচবে একটি পরিবার।বাঁচবে আমাদের মানবিকতা। আমরা বলতে পারবো,আমরা আধুনিক সভ্যতার একজন দরদী সত্যিকারের মানুষ। যে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলে–” বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও..”।
এসো আজ আমরা অঙ্গীকার করি আমরা সমাজের সব স্তরে এই রক্তদানের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ উদ্যোম গ্রহন করি,আমাদের জন্য,মানুষের জন্য..আমাদের সহ নাগরিকদের জন্য। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।