স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় নারীদের অবদান

শাওলী রায়, আগরতলা

ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করতে  ভারত মাতার বীর সন্তানদের পাশাপাশি বীরাঙ্গনা নারীরাও এগিয়ে এসেছিল।বহু বীরাঙ্গনাদের কথা ইতিহাসের পাতাতে উল্লেখিত থাকলেও এমন বহু বীরাঙ্গনা রয়েছেন যাঁদের আত্মত্যাগ এর বীর কাহিনী হয়তো চাপা পড়ে গেছে বিস্মৃতির অন্তরালে।স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সকল বীর শহীদদের পাশাপাশি সকল বীরাঙ্গনা নারীদের যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের দেশের মহান স্বাধীনতা।

বিশেষ করে স্মরণ করতে হয় রাণী ভেলু নাচিয়ার কথা।১৭৩০ সালে ৩ জানুয়ারি  রমনাথপুরমে তিনি জন্মেছিলেন। তাঁর স্বামী মুথুভাগুগনাথপেরিয়া উদয়াভের মৃত্যু হয়েছিল ব্রিটিশের হাতে ।১৭৮০ সালে  ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধে এই রাণী তাঁর অনুচর  কুইলি কে আত্মঘাতী মানব বোমা হিসেবে ব্যবহার করে ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।তিনি তাঁর রাজত্ব পুনুরুদ্ধার করেন ও দশ বছর ধরে শাসন ক্ষমতা চালিয়ে যান।

দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী বাই এর ভূমিকা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়।তাঁর স্বামী ঝাঁসির মহারাজ গঙ্গাধর রাও নিয়াকরের মৃত্যু হলে ইংরেজ ঝাঁসির কেল্লা দখল করতে চান।ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর গভর্নর লর্ড ডালহৌসি এর  সত্ব বিলোপ নীতির কারণে তখন তাঁকে বার্ষিক ৬০,০০০টাকা ভাতা দেবার কথা বলে ইংরেজ ঝাঁসি দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠে।ব্রিটিশ বাহিনী ঝাঁসী অবরোধ করলে রানী লক্ষ্মীবাই তাঁর সেনাদল গঠন করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।২৩ মার্চ,১৮৫৮ ব্রিটিশ বাহিনী ঝাঁসী অবরোধ করে। লক্ষ্মীবাই তাঁর বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন।১৭ জুন ফুলবাগ এলাকার কাছাকাছি কোটাহ -কি – সেরাইয়ে ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে  শহীদ হন।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার চট্টগ্রামে মাস্টারদার নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন।ব্রিটিশের হাতে ধরা পরার চেয়ে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্ম বলিদান দেন। চট্টগ্রামের অন্যতম বীরাঙ্গনা কল্পনা দত্ত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন এর সময় ধরা পরলে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।মাস্টারদার ফাঁসি হয়েছিল।

দেশ মাতৃকাকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা ব্রিটিশ  শাসনকালে তিনি লবণ আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেন।প্রথমে গ্রেপ্তার হলেও পরে ছাড়া পান।মেদিনীপুর জেলা থেকে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদের লক্ষ্যে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।১৯৪২  সালে তমলুক থানা দখলের উদ্দেশ্যে ছয় হাজার সেচ্ছসেবক সহ একটি মিছিল বের হয় সেই মিছিলে নেতৃত্ব দেন ৭৩ বছরের  মাতঙ্গিনি  হাজরা। তখন ব্রিটিশ সরকার তমলুক শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে।১৪৪ ধারা ভেঙে এই মিছিল এগিয়ে গেলে ব্রিটিশ পুলিশের গুলি বর্ষণে তাঁর মৃত্যু হয়।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন কনকলতা বড়ুয়া।অসমের প্রথম নারী শহীদ।১৯২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর অসমের গহপুর অঞ্চলে তাঁর জন্ম। জ্যোতি প্রসাদ  আগরওয়ালার  নেতৃত্বে তিনি  মৃত্যু বাহিনীতে যোগ দেন।ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে আসাম শাখার  হয়ে কাজ করতে গিয়ে সব থানা গুলোতে ব্রিটিশ পতাকার পরিবর্তে ভারতের পতাকা উত্তোলন করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি ।১৯৪২ সালে গহপুরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত থানা অভিমুখে অগ্রসর হওয়া মৃত্যু বাহিনীর সদস্যদের সম্মুখে হাতে পতাকা নিয়ে অগ্রগামী মিছিলকে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।সেই সময় ব্রিটিশ পুলিশের  গুলিতে  তিনি আত্ম বিসর্জন দেন।

আমরা স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি  আরো বীরাঙ্গনা মনোরমা বসু,সুচেতা কৃপালিনী ,লক্ষ্মী সেহগাল ,সরোজিনী নাইডু প্রমুখ বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগের কথা ।আজ সারা দেশে স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষ পূর্তিতে অমৃত মহোৎসব পালিত হচ্ছে ।আমাদের রাজ্য ত্রিপুরায় গত তিন দিন ধরে চলছে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব। এই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে আমাদের মনে করতে হবে তাঁদের অবদানের কথা ।তাঁদের আত্মত্যাগ এর কারণেই আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক ।আজও স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও নারীদের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হচ্ছে । ধর্ষণ , শ্লীলতাহানির মত ঘটনা চলছে নিত্য দিন।কর্ম ক্ষেত্রে, বাসে,ট্রেনে, সর্বত্র নারীরা আজও সুরক্ষিত নয় ।স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে আসুন আমরা শপথ নেই দেশের বা বিশ্বের প্রতিটি নারী সুরক্ষিত রাখবো।নারীরা সুরক্ষিত থাকলেই দেশ বা বিশ্বের উন্নতি সম্ভব। ভারতবর্ষ গার্গী,অপালা,মৈত্রেয়ী এর দেশ।তাঁদের আদর্শ কে অবলম্বন করেই ভারত আবার জেগে উঠবে।

Related posts

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

চৈত্র বৈশাখ মধুমাধবের মায়ায় মায়ায়