“শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ…” এবং বিদ্যাসাগর, ১৭৫ বছর আগের একটি ঘটনা

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

১৮৪৮ সালের মার্চ মাস…ব্রিটিশ রাজত্বের অধীনে ভারতবর্ষ তথা আমাদের এই বাঙলাপ্রদেশ। সারাদেশ তথা সারা বাঙলা ইংরেজদের পদলেহনে ব্যস্ত। সাধারণত সকলেরই ধারণা যে ইংরেজরা কত শিক্ষিত, সুসভ্য জাত। এ কথা যেমন সেই সময়ের বাঙালির বিশ্বাসে ছিল, তেমনই ইংরেজদের একটা দম্ভও ছিল, একটা দেমাকিভাবও ছিল এই বিষয়ে। সেইজন্য তারা এ দেশের মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো, ছলে-বলে-কৌশলে অপমান, অত্যাচার,
অন্যায়াচার করতে এতটুকু দ্বিধা করত না।

এহেন সময়ে তখন কলকাতার হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন মি. গ্রাহাম কার। আর আমাদের বাঙলার মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামের সিংহ শিশু (তখন তিনি মধ্যবয়সী) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন ফোর্টউইলিয়াম কলেজের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান। ইংরেজ পন্ডিত মানুষ উইলিয়াম কেরী সাহেব, জন ড্রিঙ্কিনওয়াটার বীটন (যিনি বেথুন সাহেব নামে ইতিহাস বিখ্যাত), ডেভিড হেয়ার সাহেব, প্রমুখরা বিদ্যাসাগরের পাণ্ডিত্য এবং ব্যক্তিত্বকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু সব ইংরেজ তো আর ওঁদের মতো সুমার্জিত ছিল না।

যাইহোক, একদিন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কী একটা কাজের প্রয়োজনে হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ মি. গ্রাহাম কার-এর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। গ্রাহাম কার তার ঘরে তখন তার বুট পরা পা দুটো টেবিলের ওপর তুলে আয়েসি মেজাজে বসে আছে। বিদ্যাসাগর ঘরে ঢুকলেন, টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, কিন্তু গ্রাহাম কার বিদ্যাসাগর মশাইকে বসতে তো বললেন-ই না,উল্টে বুট পড়া পা দুটোও ভদ্রতার খাতিরে টেবিলের ওপর থেকে নামালেন না। এক চরম অবজ্ঞা,তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য তার আচরনে প্রকাশ পেল। বিদ্যাসাগর কাজের কথা সেরে কিচ্ছুটি না বলে সেদিন চলে এসেছিলেন গ্রাহাম কারের ঘর থেকে। কিন্তু জেদি এককাট্টা, একরোখা স্বভাবের মানুষ বিদ্যাসাগর মনে রেখে ছিলেন সেই ঘটনাটি। দিন সাতেক পরে একদিন নিজের দরকারে গ্রাহাম কার আসছেন বিদ্যাসাগরের সাথে সাক্ষাৎ করতে… এই কথা শোনা মাত্রই বিদ্যাসাগরের মনে পড়ে গেল সেদিনের অপমানের কথা।তিনি মিঃ কার আসছেন শুনে,তার সেই বিখ্যাত বিদ্যাসাগরী চটি জোড়া পা দুটি টেবিলের ওপর তুলে দিয়ে বসে রইলেন।

মি. কার বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ঘরে ঢুকলেন। বিদ্যাসাগর মশাই কিন্তু পা দুটি সেদিন টেবিল থেকে নামাননি।গ্রাহাম কার-কে চরম অপমান করলেন। কাজের কথা বলে গ্রাহাম সেদিন অপমানিত হয়ে বেরিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড রাগে তখনকার শিক্ষা অধিকর্তা মি. ময়েট-কে বিষয়টি নিয়ে নালিশ করলেন বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে।

সব শুনে মি. ময়েট বিদ্যাসাগরকে ডেকে পাঠালেন এবং তিনি জানতে চাইলেন কেন তিনি ওইরকম অসভ্য আচরণ করেছিলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর খুব ধীর স্থির ভাবে বলেছিলেন যে ইংরেজরা তো বলে, যে,তারা না কি সুসভ্য জাতি বলে নিজেরা দাবি করে। তাই তিনি মি. গ্রাহাম কার-এর ওই ধরনের আচরনকে ইংরেজদের সুসভ্য শিষ্টাচার মনে করেই গ্রাহাম কারকে চটি জোড়া দেখিয়েছিলেন।

এই বলে বিদ্যাসাগর মি. গ্রাহাম কারের অসভ্য আচরনের কথাও বললেন। সব শুনে মি. ময়েট বুঝলেন যে, আসল দোষী হলেন মি. গ্রাহাম কার। ময়েট বিদ্যাসাগরের কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং গ্রাহাম কার-কে ডেকে তার অভব্য ব্যবহারের সমালোচনা করে তাকে তিরস্কার করেন,আর তাকে তার আচরণের জন্য বিদ্যাসাগরের কাছে ক্ষমা চাওয়ান।

এই হলেন আমাদের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর… যিনি এক কথায় বলা যায় আমাদের এই দেশের,এই বাঙলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ। এই ঘটনা ঘটেছিল ১৮৪৮ সালের এই মার্চ মাসে। আজ থেকে ১৭৫ বছর আগে।
আসুন জাতীয়তাবোধের জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতি রেখে যাই আমাদের অকুণ্ঠ বিনম্র শ্রদ্ধা এবং প্রণাম।

Related posts

কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর, সে-দেহে তাহার কোন প্রমাণ ছিল না

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী