আজ যথার্থ শিক্ষা দিবসে বিদ্যাসাগরের চরণ ছুঁয়ে যাই…

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

অন্যান্য দিনের মতো আজকের দিনটাও আমার শুরু হয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু,হঠাৎ সেখানে এক নতুনত্ব জন্ম দিল একটা ঘটনা। দেখি,মা-বাপ মরা দাদু ঠাকুমার কাছে মানুষ হওয়া ৭/৮ বছরের গুড্ড দুহাত দিয়ে তার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে থাকা একটা মলাট দেওয়া বই নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে।গুড্ডুর ঠাকুমা আমাদের বাড়িতে ঘর মোছে,বাসন মাজে।গুড্ডুর নাম আনিরুল।ওর জন-মজুর খাটা দাদু আব্দুল নাকি ওকে বলেছে,যে আমরা যা কিছু শিখি,সব আল্লাহ শেখায়,যদিও সে
সেকথা মানতে চায়নি, তাই আমার কাছে তার আসা।

আমাকে গুড্ডু এইকথা বলতে আমিও বললাম,যে ঠিকই তো,আমরা যা শিখছি, সব ভগবানই তো শেখাচ্ছে। গুড্ডু এককথায় আমার কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল,না আল্লা,ভগবান কেউ শেখায় না আমাদের,যে সত্যি সত্যি শেখায়,সে এই দ্যাখো আমার এই বইতে তার ছবি আছে,তার নামও আছে আমার এই এই অ আ ক খ-এর বইতে। গুড্ডু বুকের কাছে ধরে থাকা মলাট দেওয়া বইটার মলাট উল্টোতেই দেখি বিদ্যাসাগরের ছবি…অ আ ক খ -র প্রথম ভাগ। নীচে লেখা নাম।

আমি চমকে উঠলাম।সত্যিই তো,আমাদের যা কিছু শেখা জানা,সবই তো এই বিদ্যাসাগরের প্রথমভাগের অ আ ক খ দিয়েই শুরু প্রত্যেকের জীবনে। আজ গুড্ডু এক চরম সত্যি আমাকে শেখাল। তারপরই মনে পড়ে গেল আজকের তারিখ…২৬ শে সেপ্টেম্বর। আজ তো আমাদের সকলের ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের পূণ্য পবিত্র জন্মদিন।

আমাদের তো কোনো আল্লাহ ভগবান, অক্ষর,বর্ণমালা শেখান না।শেখান বিদ্যাসাগর। আজ সেই মহামানবের জন্মদিন। যে মহামানবের কাছে আমাদের পূর্ব পুরুষ থেকে আমরা আজকের সকলে এবং আগামী দিনের প্রজন্মের পর প্রজন্ম চিরকাল ঋণী হয়ে ছিলাম,আছি,থাকব…অক্ষর বর্ণমালা চেনা-জানা-শেখার জন্য।

সকলকে ডাকলাম। বিদ্যাসাগরের ছবি দেওয়াল থেকে নামিয়ে টেবিলে রাখলাম।তারপর, ছাদের টব থেকে তুলে আনা ফুল গুড্ডুর হাত দিয়ে বললাম আয় আমরা সকলে আমাদের সত্যিকারের শিক্ষককে আজ তার জন্মদিনে প্রণাম জানাই।

মনে পড়ে গেল, আজ থেকে ১৭০/১৭৫ বছর আগে তখনকার অবিভক্ত বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে হিন্দু মুসলিম গরীব মানুষদের আর শহরের বুকে হিন্দু মুসলিম খেটে খাওয়া কুলি মজুরদের (বিদ্যাসাগর নিজেও কুলি হয়ে মাথায় মোট বয়েছিলেন), গরীব-গুর্বোরা মুখে মুখে গান বেঁধেছিলেন…
“বিদ্যাসাগর হে একবার এসোনা আমাদের গাঁ-য়েতে../
মাথায় করে রাখবো তোমায় মুদের ঘরের ছায়েতে..”। অবিভক্ত বাংলার
হিন্দু-মুসলমান তাঁতীরা তাদের বোনা কাপড়ে লিখতেন.. “বেঁচে থাকো ওগো বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে,তুমি চিরজীবী হও,/ মোদের কথা কেউ বলেনা,শুধু একলা তুমি কও…।”

তাই আমাদের কাছে বিদ্যাসাগর এক চিরন্তন শাশ্বত সূর্য.. যার আলোয় আমরা আলোকিত।

Related posts

কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর, সে-দেহে তাহার কোন প্রমাণ ছিল না

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী