পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
প্রতি বছর ২৬ জানুয়ারির দিন সূর্যোদয়ের রক্তিমরাগে বেজে ওঠে ভোরের ভৈরবী কোমল রেকাবের স্বরলিপি নিয়ে। ভারতবর্ষের সমস্ত আকাশ ছেয়ে যায় সাধারনতন্ত্র প্রজাতন্ত্র দিবসের উজ্জ্বলতায়, উচ্ছ্বলতায়।
সময়ের স্বরলিপির নাম বোধহয় ইতিহাস। সেই সময়ের হাত ধরে পেরিয়ে এলো ভারতবর্ষ-এর প্রজাতন্ত্র দিবসের ৭৫ টি বছর।
প্রতিবারই সামরিক বাহিনীর ব্যান্ডের সমবেত মূর্ছনায় বেজে ওঠে আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত-“জনগণমন অধিনায়ক জয় হে, ভারতভাগ্যবিধাতা”। এতো আমাদের দেশের এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্য এবং পরম্পরা।
কিন্তু এই জাতীয় সঙ্গীত ” জনগণমন”-র ইতিহাস,প্রেক্ষিত,এবং তার ইতিহাসের কতটাই বা আমরা জানি? ১৯১১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম এই গানটি রচনা করেন। এই গানের সুর আলাহিয়া বিলাবল রাগে আশ্রিত। ১৯১১ সালে এই গান যেদিন বা যখন সৃষ্টি করছিলেন রবীন্দ্রনাথ,তখন এই গান যে আমাদের দেশের জাতীয়সঙ্গীত হিসাবে নির্বাচিত হবে,বা গৃহীত হবে, সে সবের কোনও সম্ভাবনাই ছিলনা।
আমরা যদি এই গানের বাণী এবং সুরের নকশীকাঁথার ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটি,যদি এই গানের স্বরলিপির শীতলপাটিতে কিছুক্ষণ বসি নিমগ্ন অন্তরে,তাহলে,দেখতে পাবো,গানেরই দুইপাশে, দু’কুল ছাপিয়ে নদ নদীর অবিরাম স্রোতধারা বয়ে চলেছে এক ধারাবাহিক পরম্পরায়। তার দু’ধারে ঢেউ খেলে যায় সোনার শ্যামল অমল রোদ মাখানো শস্যক্ষেত, ফসলের মরাই,ফসলের খামার। তার পাশে কোথাও ঋষিরা গাইছেন সাম-গান,কোথাও শিশুদের সাথে আপনমনে খেলে বেড়ায় চড়াই,শালিক,দোয়েল,পায়রার ঝাঁক। গায়ে গায়ে প্রতিবেশীর মতন পর্ণকুটিরের সারি। মন্দির মসজিদ একাকার যেখানে। সেখানেই নিজেকে চেনার,জানার পথ খুঁজে পাওয়া যায় কোনও ধর্ম ছাড়াই।
এগিয়ে চলে সময়,এগিয়ে চলে ইতিহাসের অধ্যায়। দেখতে পাই তথাগত বুদ্ধের ক্ষমাসুন্দর সারল্যের মুগ্ধতায় চেয়ে আছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু,নিজামুদ্দিন আউলিয়া,শিরডির সত্যসাঁই,লালন ফকির,মীরাবাঈ, গুরু নানক,সন্ত রুইদাস,সন্ত কবীর,প্রমুখ স্মরণীয় বরণীয় বরনীয়াগণ– শুদ্ধসত্ত্বতায় আহ্বান শোনা যায় পরমপুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের “যত মত তত পথ”-এর শেষে সেই একমেবাদ্বিতীয়ম বিরাজমান। দেখতে পাই বিশ্বময়ী বিশ্বমায়ের আঁচল খানি পেতে বসে রয়েছেন শ্রীমা সারদা-” রাখাল যেমন আমার ছেলে,আমজাদও তেমনই আমার ছেলে..”। মরমের অন্তঃস্থলে লেখা হয়ে যায় স্বামী বিবেকানন্দের সেই অমোঘ তেজোময় বাণী–“হে বীর সাহস অবলম্বন কর,সদর্পে ডাকিয়া বলো,মুর্খদরিদ্র ভারতবাসী আমার ভাই,আমার বোন। –মনে রেখো,তুমি জন্ম হতে মায়ের জন্য,জন্মভূমির জন্য বলি প্রদত্ত..।” তাই আমাদের এই জাতীয় সঙ্গীত ভারতবর্ষকে এক অখণ্ড ভূখণ্ডে পরিণত করে দিয়ে যায়।করেও দিয়েছিল। কিন্তু তারপর?
১৯১১ সালে পরাধীন ভারতবর্ষে কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রথম গাওয়া হয়েছিল এই জনগণমন গানটি। তখন নাম ছিল, “ভারতভাগ্যবিধাতা”। ব্রহ্মসঙ্গীত হিসাবে “তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা”য়
প্রথম ছাপা হয়েছিল। এর সাত বছর পরে ১৯১৮ সালে,বিশিষ্ট আইরিশ কবি এবং বেসান্ত থিওসফিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল মিস্টার জেমস্ এইচ কাজিন্স- এর আন্তরিক আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের মদনপল্লীতে।সেখানেই এক ছাত্রদের সম্মেলনে বিশ্বকবি স্বকণ্ঠে বাংলায় এই গানটি গেয়েছিলেন। ভাষার বোধগম্যতা কিন্তু সেদিন কোনও অন্তরায় হয়নি,সুরের সুষমায় মুগ্ধ করেছিল শ্রোতৃমন্ডলীকে। সেই গানের সুরে সুরে বাঁধা রয়েছে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের গভীর নিবিড় সঙ্গীতবোধ। ঠিক যেমনটি রয়েছে বিঠোফেনের নাইন্থ সিম্ফনির ” Odd to joy..”- এর মধ্যে।
সেইদিন সেইখানে উপস্থিত ছিলেন মিসেস মার্গারেট কাজিন্স(মিস্টার জেমস এইচ কাজিন্সের স্ত্রী)। তিনি ছিলেন পাশ্চাত্য সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ। তিনি বুঝেছিলেন এই গানের পাশ্চাত্য গ্রহনযোগ্যতার গভীরতাকে।তাই তাঁরই একান্ত অনুরোধে কবিগুরু এই গানটির ইংরাজি অনুবাদ করলেন–” The morning song of India”. স্বরলিপি করলেন স্বয়ং মিসেস মার্গারেট কাজিন্স। তিনিই প্রথম এই গানের সুরকে পাশ্চাত্য পদ্ধতির নোটেশনে সাজিয়ে অর্কেস্ট্রার সাথে মিশিয়ে দিলেন সুরের ব্যঞ্জনায়।সেই স্বরলিপিই আজও অনুসরণ করা হয়।
আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত-এর প্রথম দাবী ওঠে রাজনৈতিক মহলে,বুদ্ধিজীবী মহলে,১৯৩০ সালে। ১৯৩৭ সালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এই “জনগণমন” গানটিকেই আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ১৯৪২ সালের ২৯শে মে তারিখে নেতাজীর উদ্যোগেই জার্মানীর হামবার্গ শহর থেকে রেডিও তরঙ্গে এই “জনগণমন” গানটি ছড়িয়ে দেওয়া হয় আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে সারাবিশ্বে। ১৯৪৩ সালের ৫ই জুলাই তারিখে, যেদিন আজাদ হিন্দ ফৌজ আনুষ্ঠানিকভাবে গঠনের কথা ঘোষনা করা হয়েছিল,সেইদিনই প্রথমবারের জন্য এই “জনগণমন” গানটি আনুষ্ঠানিকভাবেই জাতীয় সঙ্গীত হিসাবেই গীত হয়েছিল সমবেত আজাদ হিন্দ বাহিনীর নারী-পুরুষ দেশপ্রেমিক সন্তানদের দ্বারা।
দেশ স্বাধীন হল,১৯৪৭ সালে।কিন্তু তখনও আমাদের কোনও জাতীয় সঙ্গীত ছিল না। রাজনৈতিক নেতাদের অকর্মন্যতাই বলা যায়। যদিও, নেতাজীর উদ্যোগে এই গান তখন সারাবিশ্বে সমাদৃত। রাস্ট্রসঙ্ঘও মুগ্ধ এই গানের সুরে এবং বাণীতে। অবশেষে সেইসময়ের দেশীয় নেতারা এই অনিন্দ্যসুন্দর গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহন করলেন রাস্ট্রসঙ্ঘের তৎপরতায়।
এরপর ১৯৫০ সাল। ২৬ শে জানুয়ারী দেশের প্রথম সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর করা হবে। দিনটি পালিত হবে সাধারণতন্ত্র প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে,কিন্তু জাতীয় সঙ্গীত কোথায়? অবশেষে, ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারী, প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহরু,রাস্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ সহ নেতৃবৃন্দ “জনগণমন” গানটিকে ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে স্বীকৃতি দিলেন সর্বসম্মতিতে।
ভারতবর্ষের আত্মার সাথে,জাতীয়তাবাদের সুরমুর্ছনায়,আনুষ্ঠানিক ভাবে আকাশে বাতাসে ধ্বণিত হতে শুরু করল, ” জনগণমন অধিনায়ক জয় হে,ভারতভাগ্যবিধাতা,জয় হে, জয় হে,জয় জয় জয় হে..”।
আমাদের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য এবং পরম্পরায় ঝরে পড়তে শুরু হোল দেশমাতৃকার আশীর্বাদ।