অবহেলিত আফ্রিকা শেখায় এক নতুন কথা— “I am, b-coz We are…”

সবাই থাকি সবার সাথে। প্রতীকী ছবি সৌজন্যে african people & wildlife

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

আমরা সকলেই জানি আমাদের এই পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের অন্যতম মহাদেশ হল আফ্রিকা। আফ্রিকায় ছোট মাঝারি অনেক দেশ আছে।আফ্রিকার সেইসব দেশে দেশে একসময়ে ছিল ঐতিহাসিক ঐতিহ্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মালি সভ্যতা। প্রকৃতিগতভাবেই আফ্রিকা মহাদেশ নানারকমের প্রাকৃতিক সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার। এই বিশাল ভাণ্ডারের খবর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকা মহাদেশের বাইরের জগতে। তার ফলে, শুরু হয়েছিল সভ্য জগতের লোভ।সেই লোভ থেকেই জন্ম নিয়েছিল অসততা,সুযোগ সন্ধানীর চতুরতা আর হিংস্রতা। এই কাজে যুক্ত হয়েছিল ইউরোপ মহাদেশের ব্রিটিশরা,ফরাসীরা,
স্পেনীয়রা, পর্তুগীজরা, ওলন্দাজরা।

আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলি চলে যায় ইউরোপের ঐসব সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অধীনে। পরাধীন হয়ে যায় আফ্রিকা। ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী এই দেশগুলো আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করঅতে শুরু করে এবং সেইসব সম্পদ যে যার দেশে নিয়ে যেতে লাগলো। নিজেদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাতে লাগলো শোষক দেশগুলো। আর দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে লাগলো আফ্রিকার দেশগুলি। সেখানকার মানুষের ভালো করে খাবার জুটতো না,অত্যাচারের সীমা পরিসীমা ছিলনা।কারন,ব্রিটিশ, ফ্রান্স,পোর্তুগীজ,ওলন্দাজ,স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আফ্রিকার কালো নিগ্রো নারী-পুরুষদের হাতে পায়ে শেকল পরিয়ে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করত আমেরিকায়, জার্মানে, ব্রিটেনে, স্পেনে, ডেনমার্কে, পর্তুগালে এবং পৃথিবীর নানা দেশে। এইসব সভ্য জগতের দেশগুলো এই বিশ্বকে দেখালো,কিভাবে মানুষ মানুষকে পণ্য করে,কিভাবে মানুষ লোভ আর হিংস্রতায় অমানুষ হতে পারে।

এই অত্যাচার শত শত বছর ধরে আফ্রিকার বুকের ওপরে চলেছে।আজও চলছে। পরাধীনতার গ্লানি নিয়ে বেশ কিছু দেশ আজও চরম শোষনের শিকার হচ্ছে। আফ্রিকার মানুষকে এইসব শোষক সাম্রাজ্যবাদী দেশের শাসকরা মানুষ বলেই মনে করেনা। তাই তারা অত্যাচারের ধারাবাহিকতা চালিয়ে যায় বছরের পর বছর।জন্ম নেয় ক্ষোভ,বিদ্রোহ,হিংসা। পাশাপাশি সমাজে জন্ম নেয় করাপশন। বিশ্বের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ যুগে যুগে আফ্রিকার ওপরে এই অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছেন বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে।আফ্রিকা মহাদেশের অভ্যন্তরে,এবং বহির্বিশ্বেও।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়,আব্রাহাম লিঙ্কন(আমেরিকার প্রেসিডেন্ট /তিনি আততায়ীর গুলিতে প্রাণ দেন),ডঃ মার্টিন লুথার কিং (ইনিও আততায়ীর গুলিতে খুন হন),বিখ্যাত সঙ্গীতকার পল রোবসন(ইনিও আততায়ীর গুলিতে খুন হন),আরনেস্টো চে গ্যেভারা (এনাকে গুলি করে হত্যা করা হয়), মহাত্মা গান্ধী (এনাকে আততায়ীর গুলিতে প্রাণ দিতে হয়),দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা(২৮ বছর জেলবন্দী ছিলেন),কবি বেঞ্জামিন মোলায়েজ(এনাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসী দিয়ে খুন করা হয়)…প্রমুখ।

আফ্রিকার পাশে ছিলেন আইনষ্টাইন,এডিসন,পীট সীগার,হ্যারী বেলাফন্তে,বব ডিলান,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,জর্জ বার্নাড শ, ম্যাক্সিম গোর্কি,বারট্রান্ড রাসেল, ব্রেখট,কার্ল মার্ক্স,লেনিন,হোচিমিন,ফিদেল কাস্ত্রো,গ্যারিবল্ডি, টলষ্টয়, মহাত্মা গান্ধী, বিজ্ঞানী টেসলা,প্রমুখ।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা “আফ্রিকা”-তে—” প্রাচী ধরিত্রীর বুক থেকে/ ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে,আফ্রিকা –/…. এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে,/ নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,/ গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।/ সভ্যের বর্বর লোভ/ নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।// তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে/ পঙ্কিল হল ধুলি,তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে,/ দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়/ বীভৎস কাদার পিণ্ড/ চির চিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।।”

ক্ষুধার্ত, অত্যাচারিত, অপমানিত, অবহেলায়,লাণ্ছনায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাটানো আফ্রিকার মানুষ এক নতুন পথের দিশা দেখিয়েছে বাদবাকি বিশ্বের মানুষকে। আফ্রিকা মহাদেশের একটি ছোট্ট দেশের মানুষের ভালোভাবে খাবার জোটেনা, এমনকি জানা যায় যে সেখানকার মায়েরা ঘাসপাতা আর সবজি দিয়ে নরম মাটির খাবার তৈরি করে খাওয়ায় বাচ্ছাদের।কেউ খায়,কেউ খায় না। রাতের বিছানায় তারা প্রতিদিন স্বপ্ন দেখে মানুষের উপুযোগী খাবারের।

এহেন জঘন্য নগন্য সাধারণ মানুষের জীবনধারায় মাঝেমধ্যে আনন্দের উৎসব আসে,যখন সেখানে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান করা হয়। সেখানে নিয়ম করা হয় প্রতিযোগিতায় দৌড়ে যে ফার্স্ট হবে,সেকেন্ড হবে,থার্ড হবে, তাদের দেওয়া হবে কেক, পাউরুটি, বিস্কুট, ইত্যাদি,ইত্যাদি।

তেমনই এক প্রতিযোগিতায় দেখা গেল এক অভিনব ব্যাপার। সেটা হল,যথা নিয়মে,যথা সময়ে প্রতিযোগীতায় বেজে উঠলো বাঁশির হুইসিল। শুরু হোল দৌড়ানো। কিন্তু একি? এ কি দেখছে উপস্থিত সকলে? তারা দেখছে প্রতিযোগিতার প্রত্যেকটা লেনের প্রতিযোগী পরস্পর পরস্পরের হাতে হাত দিয়ে ধরে দৌড়চ্ছে প্রথম হওয়ার লক্ষ্যে। উপস্থিত বিচারকমণ্ডলী, প্রতিযোগিতার স্পন্সররা সবাই প্রশ্ন তুললো, এটা কি ধরনের খেলা?এইরকম করার মানে টা কি!!??

ছোট ছোট প্রতিযোগিরা জানে, এইরকম টা করার মানেটা কি। তারা কেউ একা ফার্স্ট হতে চায় না, সবাই ফার্স্ট হতে চায়, কারণ, সবাই ফার্স্ট হলে কেক,পাউরুটি বিস্কিট তারা সকলেই প্রাইজ হিসাবে পাবে,আর সকলেই একসাথে খেতে পারবে সেইসব সুস্বাদু খাবার।যা তাদের কাছে স্বপ্ন। হ্যাঁ, এই ছোট ছোট শিশুরা শিখিয়ে গেল জীবনে বেঁচে থাকার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী। শিশুরা সমস্বরে উত্তর দিল তাদের ভাষায় –“ubuntu…ubuntu…”. যার মানে হোল, আফ্রিকার Xhoans ভাষায়…”আমরা আছি,তাই আমি আছি।আমরা নেই,তখন আমিও নেই..”। যার ইংরেজি তর্জমা হল–” I am, b-coz We are”.

হ্যাঁ,২০২৪ এর এই আধুনিক সময়ে, শত শত বছরের নিগৃহীত ক্ষুদার্থ, অপমানিত, অত্যাচারিত আফ্রিকা শেখাল আধুনিক স্বার্থপর অসহিষ্ণু পৃথিবীকে– “একা নয়,সকলকে নিয়ে বেঁচে থাকার নামই হলো ঠিক করে বাঁচা…”। সমষ্টিগত ভাবে ” আমরা” আছি বলেই একক ব্যক্তিগত এই “তুমি”- “আমি” আছি,নইলে নয়।

আসুন আজকের আধুনিক পৃথিবীতে এই হোক শাশ্বত আহ্বান —
” I am, because, We are..”
আমরা আছি-র মধ্যেই আমি আছি।
আমরা আছি বলেই আমি আছি।

মনে পড়ে যায় আমাদের এই বাঙলার কবি কামিনী রায়ের লেখা সেই কবিতার পঙক্তিগুলি,যা শুনে শুনে আমরা সেই শৈশব থেকে বড় হয়েছি—” সকলের তরে সকলে আমরা,/প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”

সবাই থাকি সবার সাথে,
সবাই থাকি সবার পাশে।

Related posts

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

চৈত্র বৈশাখ মধুমাধবের মায়ায় মায়ায়