নেতাজী :— ভারতবর্ষের আবেগের জাগ্রত বিবেক

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু — একটি নাম, একটি আবেগ, একটি আদর্শ, একটি প্রতিজ্ঞা। সারা বিশ্বে চির রহস্যে ঘেরা একটি মানুষের জীবন বোধহয় নেতাজী ছাড়া আর কারোরই নেই। সুভাষচন্দ্র বসু একমাত্র নেতৃত্ব — যিনি ছিলেন আমাদের দেশের ভিতরে এবং দেশের বাইরেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় সংবেদনশীল এবং সফল নেতা। এই সত্যকে স্বীকার করে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন :— “The greatest and lasting act of Netaji was that he abolished all distinctions of caste and class. He was not a mere Bengalee, He was Indian first and last.”

এই পরিপ্রেক্ষিতে মহাত্মা গান্ধীর জীবনের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সময়টা স্বাধীনতার আগের বছর, এদেশে শুরু হোল বিভৎস ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা, ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগষ্ট। ছড়িয়ে পড়লো সারা দেশে। খুন, ধর্ষন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, কিছুই বাদ ছিল না সেদিন। সারাদেশের মানুষের এক মর্মান্তিক চরমতম অবস্থা। একদিকে সাধারণ মানুষ খুন হচ্ছে, ঘর বাড়ি জ্বলছে, মহিলাদের মান ইজ্জত লুট হচ্ছে, দিশেহারা হয়ে দেশবাসী প্রতি মুহুর্তে সর্বনাশের মুখোমুখি হচ্ছে, আর, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলি, নেতারা দেশ ভাগের ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রয়েছে চাপান উতোরে, বাক বিতণ্ডায়। শুধুমাত্র একা গান্ধীজি ছুটে বেড়াচ্ছেন এখানে ওখানে। আবেদন করছেন সকলকে শান্তি আর সম্প্রীতির। আর বোধহয় মনে মনে উপলব্ধি করছিলেন তার প্রিয় সুভাষের কথা। তার মনে পড়ে যাচ্ছে এর বেশ কিছুদিন আগেই… কখনো বার্লিন থেকে, আবার, কখনো দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সেই সতর্কবাণী :—” I have no doubt that if India is divided, she will be ruined. I vehemently oppose the Pakistan scheme for vivisection of our Motherland, our devine Motherland shall not be cut up.” (আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে,ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে তার ধ্বংস অনিবার্য। মাতৃভুমির এই বিভক্তিকরণের আমি তীব্র বিরোধিতা করছি। আমার পূণ্য পবিত্র মাতৃভূমি যে কোন প্রকারেই দ্বি-খন্ডিত না হয়।)

কিন্তু কে শোনে সে সব কথা। নেতারা তখন ব্যস্ত ভাগ-বাঁটোয়ারাতে। শুধুমাত্র গান্ধীজি, সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফফর খান, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং শরৎচন্দ্র বসু ( নেতাজীর মেজদা) ছাড়া।

মহাত্মা গান্ধী এক সময়ে  জওহরলাল, জিন্না, প্যটেল, রাজা গোপালাচারী, কৃপালনী, প্রমুখ দেশ নেতাদের কাছে দরবার করলেন, চিঠি পাঠালেন, কিন্তু না সেদিন তিনি কোন সদুত্তর পাননি। তাই তিনি একাই ছুটলেন মানুষের কাছে দাঙ্গা থামানোর আবেদন নিয়ে।

তখন তিনি অবিভক্ত বাংলার নোয়াখালিতে দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় একটি গ্রামে। সঙ্গে অনেকের মধ্যে রয়েছেন তার এক পাঞ্জাবী অনুগামী জীবন সিং। খুব কাছের মানুষ। গান্ধীজির সাথে এক কুটিরেই রয়েছেন।

একদিন শেষ রাতে, তখনও ভোরের আলো ভালো করে ফোটেনি, হঠাৎ জীবন সিং-এর ঘুম ভেঙে গেল — তিনি চমকে উঠলেন,.. “আরে!! বাপুজি কোথায় গেলেন? বিছানায় তো নেই!! কুটিরেও নেই, কোথায় গেলেন!!” উন্মত্তের মতো জীবন সিং কুটিরের বাইরে এসে দেখলেন বাপুজি একা বসে আছেন কুটিরের সামনের মাটিতে অসহায়ের মতো। কি হয়েছে বাপুজির? মনে মনে ভাবছেন জীবন সিং। এগিয়ে গেলেন ধীর পায়ে বাপুজির কাছে। পায়ের শব্দে ফিরে তাকালেন গান্ধীজি জীবন সিং-এর দিকে। তারপর স্নিগ্ধ,প্রশান্ত কন্ঠে বললেন :—”কে? জীবন সিংজী?” জীবন সিং স্তম্ভিত। এ কি দেখছেন তিনি। না কি মায়ার বিভ্রম!! ভালো করে তাকালেন জীবন সিংজী মহাত্মা গান্ধীর দিকে। “হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছেন, বাপুজির চোখে জল”।

” বাপুজি, আপনি কাঁদছেন?” জীবন সিংজীর চোখদুটিও ভিজে উঠলো জাতির পিতার অসহায় কান্না দেখে। পাশে বসলেন জীবন সিং। সস্নেহে গান্ধীজি জীবন সিং-এর গায়ে তাঁর একটি হাত রেখে ঝরঝরিয়ে কান্নায় বলে উঠলেন :—” আমার সমস্ত তপস্যা মিথ্যে হয়ে গেছে সিংজী। সব স্বপ্ন আমার মিথ্যে হয়ে গেল। আজ এই বিরাট দেশে হিন্দু মুসলমান শিখ সকলে ভ্রাতৃঘাতী হত্যায় মেতে উঠেছে। এটা তো আমি চাইনি। কেউ আমাকে বুঝলো না, জীবন-জী, কেউ না।”

জীবন সিং বললেন : ” কেউ না!!” তিনি হতভম্ব। বললেন : “কেন?পন্ডিতজী, প্যাটেল জী, রাজেন্দর্ প্রসাদজী…কেউ না?” গান্ধীজি অসহায়ের মতো বললেন : ” না, না, কেউ না।”  একটা তীব্র হাহুতাশ বেরিয়ে এলো গান্ধীজির বুক চিরে। তিনি বলে উঠলেন : “ওরা কেউ আমাকে বুঝলো না, বোঝে নি। বুঝতেন শুধু একজনই। কিন্তু, আমি হতভাগ্য, সেও আজ আমার কাছে নেই।” জীবন সিং আলতো করে জিজ্ঞাসা করলেন : “কাছে নেই..!! কার কথা বলছেন বাপুজি??” মহাত্মার উত্তর :  “সুভাষ…সুভাষ… সুভাষ…।” এক বুক ফাটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো গান্ধীজির বুকের ভিতর থেকে।

আর কোনো কথা নয়। কোনো উত্তরও নয়। সব কথা হারিয়ে গেল মৌনতায়, একটি দেশের রক্তাক্ত শেষ রাতের অন্ধকারে। শুধু সাক্ষী হয়ে থাকলো জীবন সিং, মহাত্মা গান্ধীর কান্না আর একটি দেশের রক্তে ভেজা, কান্নায় ভেজা, আগুনে পোড়া,চারিদিকে ধ্বংসের বিধ্বস্ততার ইতিহাস।

ভারতবর্ষের আবগের বিবেক থেকে আজ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে প্রণাম জানিয়ে বলে যাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কথায় :-

“আজিকে তোমার অলিখিত নাম আমরা বেড়াই খুঁজি–,

আগামী প্রাতের শুকতারা সম নেপথ্যে আছো বুঝি।”

Related posts

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

চৈত্র বৈশাখ মধুমাধবের মায়ায় মায়ায়