“জন্মের প্রথম শুভক্ষণ…”, আমাদের প্রাণের “ঠাকুর”, রবি ঠাকুর

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

যে ঠাকুরের কোনো মন্ত্র নেই, কোনো পুজা-উপচার নেই,কোন জাত-ধর্ম নেই, নেই কোনো আবাহন-বিসর্জন, নেই কোনো ভোগের উৎসব,… অনেক কিছুই নেই যে ঠাকুরের আরাধনায়, উপাসনায়…সেই ঠাকুর…রবি ঠাকুর হলেন আমাদের প্রানের অন্তরের আদি অক্ষর…যাঁর কালজয়ী সৃষ্টি আমাদের পথ চলার পাথেয়…আমাদের আত্নিক উন্নতির একমাত্র অবলম্বন।

সেদিন ছিল আজকের মতো ৭ই মে,১৮৬১ সাল। ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ, আমাদের এই বাংলায়,এই ভারতবর্ষে, এই ধরনীর পূণ্যভূমিতে জন্মের প্রথম শুভক্ষণে এসেছিলেন আদিকবি রবীন্দ্রনাথ।

কবিগুরুর জীবনের অনেক কথাই আমরা জানি,কিন্তু আসা-যাওয়ার কি আশ্চর্য সমাপতন… রবীন্দ্রনাথের চিরবিদায়ের দিনটিও ছিল ৭ই আগস্ট, ১৯৪১ সাল,(১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২শে শ্রাবণ)। সেদিন বাংলা তথা ভারতবর্ষের সূর্য অস্তাচলের অমোঘ প্রস্থানে চলে গিয়েছিল চিরদিনের জন্য।

আজও তিনি আমাদের এই হতভাগ্য দেশের সমাজ জীবনে,ব্যক্তিজীবনে, রাষ্টীয় জীবনে প্রাসঙ্গিক। আজ এই পোড়ার দেশে যখন জাত-ধর্ম, জাত-পাত নিয়ে চারিদিকে এত অশান্তি,বিসম্বাদ, হানাহানি,তখন রবীন্দ্রনাথের সেই আহ্বান আমাদের প্রানীত করে:..” হে মোর চিত্ত পূণ্য তীর্থ,জাগোরে ধীরে,এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে…”

মনে পড়ে,রবীন্দ্রনাথের আপামর মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সেই উচ্চারণ :..” হে মোর দুর্ভাগা দেশ,যাদের করেছো অপমান,অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান…”।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর নোবেল (১৯১৩ সালের ১৩ই নভেম্বর) প্রাপ্তির সমস্ত টাকা খরচ করেছিলেন শান্তিনিকেতন,শ্রীনিকেতনের সাধারণ মানুষের জন্য পয়ঃপ্রনালী তৈরির কাজে। ১৯১৫ সালে তিনি দেশের গরীব চাষিদের কথা ভেবেই প্রতিষ্ঠা করেন কৃষক সমবায় ব্যাঙ্ক। ভারতে,তথা এশিয়ায় সেইটাই ছিল প্রথম।

কবিগুরু শান্তিনিকেতনে নিজেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন,নিজের এবং আশেপাশের সকলের।হোমিওপ্যাথি বিষয়ে তিনি যথেষ্ট পড়াশোনা করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরিকল্পনায় জমিদারী প্রথা তুলে দেওয়ার কথা প্রথম প্রয়োগ করেন শিলাইদহের জমিদারি তুলে দেওয়ার মাধ্যমে।

অন্যায়, অমানবিকতার প্রতি কবিগুরুর ছিল আপোষহীন প্রতিবাদ। কবিকে তখনকার ব্রিটিশ সরকার ১৯১৫ সালের ৩রা জুন “নাইটহুড” সম্মানে সম্মানিত করেছিল।কিন্তু ১৯১৯ সালের ১৩ ই এপ্রিল পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ-এ ব্রিটিশ সরকার দ্বারা সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করেছিলেন,এবং সেই “নাইটহুড” সম্মান লিখিতভাবে প্রতিবাদের সঙ্গে ত্যাগ করেছিলেন ১৯১৯ সালের ৩১শে মে তারিখে। গান্ধীজিকে তিনি আহ্বান করেছিলেন সেই প্রতিবাদে সামিল হওয়ার জন্য,কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে,গান্ধীজি সেই আহ্বানে সাড়া দেননি,বলেছিলেন,এই সময়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়া ঠিক হবেনা।তাদের বলে-কয়ে আমাদের স্বাধীনতা আনতে হবে। সে এক অন্য ইতিহাস।

রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন এদেশের প্রতিটি মানুষের কল্যান,শ্রী,মঙ্গল। তাইতো তিনি লিখেছিলেন.. “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে,নইলে মোদের রাজার সনে মিলবো কী স্বত্বে..?”
এই সাম্যবাদী ভাবনার মানুষ ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ।

আজও তাই তিনি আমাদের প্রানের আরাম,প্রানের ঠাকুর, আমাদের জীবনযাপনের মুল পাথেয়।

আজ তিনি নেই,কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর সৃষ্টির যাবতীয় অলঙ্কার। সেই অলঙ্কারই হোক আমাদের দেশের মানুষের একমাত্র অহংকার যা মানুষকে মানুষের পর্যায়ে উন্নীত করতে পারবে।

আজ রইল আমাদের সকলের বিনম্র শ্রদ্ধা এবং প্রণাম সেই মহামানবের পদপ্রান্তে।

(উপরে) রবীন্দ্র বন্দনার প্রস্তুতি। ছবি: রাজীব বসু

Related posts

কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর, সে-দেহে তাহার কোন প্রমাণ ছিল না

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী