পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
অন্তহীন ভালোবাসার উৎসবের নাম সরস্বতী পূজা। অতীতের আর এখনকার শহর, শহরতলী, মফস্বলের অল্পবয়সীদের উন্মাদনা উচ্ছ্বাস প্রকাশ-এর অভিব্যক্তি বোধহয় একই রকম আছে। হয়তো কিছু নতুন নতুন জিনিস, ব্যবহার,ইত্যাদি কালের নিয়মে সংযোজন হয়েছে,কিন্তু মোটের ওপর মনের নকশীকাঁথায় সেই একই রকম অনুভুতি আজও সমান তালে বিভিন্ন ধরনের মুহুর্তে অনুভুত হয়। অভিজ্ঞতাতেও তা সংযোজিত হয়।
যেমন সরস্বতী পুজোর আগে বয়েজ স্কুল থেকে গার্লস স্কুলে,আর গার্লস স্কুল থেকে বয়েজ স্কুলে পুজোর নেমন্তন্ন করতে যাওয়া। সেই ছেলে মেয়ে গুলোর কৈশোরিক বুকের মধ্যে একসাথে যেন বেজে ওঠে ভালোলাগা-ভীতিময় নানান রাগ-রাগিনীর স্বরগম।
চোখের চাউনিতে এক মোহময়তা,আবার বুকের মধ্যে ধুকপুকানি। চোখে চোখে কখনো কখনো কোনও ইশারার আদান প্রদান। মিস্টি চিলতে হাসির আলপনা। কোনও কিছু না বলেই অনেক কিছু বলে দেওয়া।
সেইসব ইশারা, একটু হাসির বিনিময়,ধীরে ধীরে কখনো সখনো একটু এগিয়ে যায়। তখন সরস্বতী পুজোর দিন সকালে সেই এগিয়ে যাওয়ারা চান টান করে বাসন্তী রঙের শাড়ী আর বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবী পাশাপাশি হাঁটে। পরিচয় হয়, এটা সেটা জানা জানি হয়। সামান্য দুরত্ব থাকে সাধারণত, কিন্তু কেউ কেউ একটু সাহসীও হয়ে ওঠে।
এইরকমই মনে পড়ে স্কুলের ইলেভেনের কল্লোলের চোখ মেয়েদের স্কুলে নেমন্তন্ন করতে গিয়ে আটকে গিয়েছিল মেয়েদের স্কুলের বড়দিদিমণির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোগা,চোখে চশমা, ফরসা একজনের দিকে।তিনিও মুচকি হেসে ছিলেন কল্লোলের দিকে তাকিয়ে। কল্লোল তো ফিদা। পুজোর দুদিন আগে কল্লোল সব বাধা ঠেলে,তক্কেতক্কে থেকে একখানি চিঠি দিয়েছিল সেই হাইপাওয়ার চশমাপরা সুন্দরীকে। এই অবধি ঠিক আছে।কিন্তু তারপর?
তারপর পুজোর দিন কল্লোলদের স্কুলে সেই মেয়েদের স্কুলের হেডদিদিমনি এসে হাজির।সঙ্গে সেই তন্বী হাইপাওয়ার চশমা। সামনে কল্লোলদের স্কুলের হেডস্যার। কিছুক্ষণ পরে কল্লোলের ডাক। তারপর কল্লোল হেডস্যারের বেতের তাড়নায় কয়েকদিনের জন্য স্কুল ছাড়া। আসলে,সেই হাইপাওয়ার চশমা মহিলা ছিলেন নতুন দিদিমণি, খুবই অল্প বয়েসের।আহারে বেচারা,কল্লোল জানবেই বা কি করে?
সরস্বতী পুজো বাঙালীর ভ্যালেন্টাইন্স ডে। সরস্বতী পুজোর দিন বিবস্বান দেখেছিল একজনকে। বিবস্বান এমনিতেই আর পাঁচজনের মতো নয়। খুব ভালো গান গাইতো।ছবি আঁকত, লেখালেখি করতো। ছোটবেলায় মা-মরা বিবস্বান পরিবারে খুব একটা আদর পেতনা। মানুষ কষ্ট পেলে দার্শনিক হয়,সক্রেটিসের এই কথাটা বিবস্বানের জন্য সুপ্রযুক্ত। সেই বিবস্বানের প্রাণের দোসর ছিল শুধু একজন,কল্যান। সেদিন কল্যান ছিল না।বিবস্বান একা এমনিই পথ চলতে চলতে দেখেছিল তাকে।দিনটা ছিল সরস্বতী পুজোর দিন।
এর কয়েকদিন পরে আবার তার সাথে দেখা হয়েছিল।এইভাবেই দিন যায়,বিবস্বানের আলাদা ব্যক্তিত্বের জন্য অনেকেই আকৃষ্ট হতো তার প্রতি। কিন্তু বিবস্বান সেসব নিয়ে ভাবতোই না।শুধু একজন ছাড়া।কিন্তু সেও ভুল বুঝে বিবস্বান কে দূরে সরে যেতে বলেছিল। বিবস্বানের সাথে তার আর দেখা হয়নি।কল্যানও জানতে পারেনি বিবস্বান কোথায় চলে গেল।সে আজ বহু বছর আগের কথা। শোনা যায় প্রায় তিরিশ বছর পরে কোনও এক তীর্থস্থানে বিবস্বানকে সন্ন্যাসী রূপে দেখা গিয়েছিল।যিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন,সেই মহিলা এবং তার সঙ্গীসাথীরা দূর থেকে বিবস্বানের নাম ধরে ডেকেছিল,কয়েকবার ডাকার পরে বিবস্বান ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছিল তাদের।না কোনও সাড়া না দিয়ে চলে গিয়েছিল সে,আরো দূরে,বহুদুরে।
সরস্বতী পুজো মানেই কলকাতা বইমেলার একটা দিন। কলকাতার এই বইমেলায় সরস্বতী পুজোর দিনে শাড়ি আর পাঞ্জাবীর ভিড় বেশীই হয়। কারণ সরস্বতী পুজোর দিন হলো সমস্ত বাধা নিষেধের ছাড়পত্র পাওয়ার দিন।
আসলে এই উন্মাদনা উচ্ছ্বাসের ঐতিহ্য এবং পরম্পরা বাঙালির রক্তের ধারাবাহিকতায় বয়ে আসছে সেই কোন যুগ থেকে।
আমাদের বাঙলায় তথা ভারতবর্ষে দেবী সরস্বতী বন্দনা অতি প্রাচীন এক পরম্পরা। সরস্বতী এই দেশের এক প্রাচীন নদীর তীরে গড়ে ওঠা এক সভ্যতা। বিদ্যা,সুর এবং জ্ঞানের দেবী সরস্বতী দেবী। বৈদিক যুগে দেবীর বন্দনা হোত।বৌদ্ধযুগেও সরস্বতী বন্দনার ইতিহাস পাওয়া যায়। সরস্বতী পুজোর রীতি প্রচলন ছিল মৌর্য যুগে, গুপ্ত যুগে,কুষান যুগে,এবং তার পরবর্তী সময়েও।
সরস্বতী পুজোর প্রচলন দেখা যায় ভারতের বাইরেও। যেমন জাপানে দেবী সরস্বতীর নাম “বাইজেন্তাইন”, ইন্দোনেশিয়ায় দেবী সরস্বতীর নাম “মিলিতা”
চায়নায় দেবীর নাম “স্যারিসিং”, শ্রীলঙ্কাতে দেবী সরস্বতী পুজিতা হন “সৌত্রামণি” নামে।
গ্রীক সভ্যতায় সরস্বতী দেবীর রূপ পাওয়া যায় “সারাস্বেজিয়া” দেবীর রূপে,যিনি জ্ঞান এবং রাগ রাগিনীর দেবী।
মা সরস্বতী আমাদের জীবনের শৈশব, কৈশোর, যৌবনের এমনকি তারপরেও আমাদের ঘরে ঘরে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত।
তাই আজ এই অশান্ত সময়ে শুভবুদ্ধির শুভবার্তা ছড়িয়ে পড়ুক অন্তর থেকে অন্তরে অন্তরে –,উচ্চারিত হোক আমাদের সকলের অন্তরে বিনম্রতায় আদি কবি মহাকবি কালিদাসের লেখা ঐতিহাসিক প্রাচীণ সেই স্তোত্রমন্ত্র–” জয় জয় দেবী,চরাচরসারে,
কূচযুগ শোভিত মুক্তাহারে।বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে,ভগবতী ভারতী দেবী নমস্তে।”
উচ্চারিত হোক বিনম্র শ্রদ্ধায় প্রণাম মন্ত্র খানি–” সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহি নমোহস্তুতে।।”
“নমো ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ। বেদ-বেদাঙ্গ- বেদান্ত-বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ।”