পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
সাহিত্যিক বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমরকাহিনী কথা “পথের পাঁচালী”-র আক্ষরিক “দুর্গা” তার ভাই “অপু”-কে রেখে চলে গেলেন সম্প্রতি, ১৮ নভেম্বর, ২০২৪ এর সকাল ৮টায়।
হ্যাঁ, বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিতের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের ছবি “পথের পাঁচালী”-র দুর্গার চরিত্রাভিনেত্রী উমা দাশগুপ্ত (বিয়ের পরে সেন) চলে গেলেন সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে।
এই উমা দেবী পরবর্তীতে আর কখনো কোনও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি। ফলে অপুর দিদি হিসাবে সেই কিশোরী দুর্গা, সেই বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকের কিশোরীর রূপেই সম্প্রতি পরলোকগতা ৮৪/৮৫ উমা দেবী, কিন্ত বাঙালির মনে,রয়ে গেছেন, রয়ে যাবেন চিরকাল।
উমা দাশগুপ্ত ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের এক অসাধারণ আবিষ্কার। যা বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুলগল্প “আম আঁটির ভেঁপু” অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত,পন্ডিত রবিশঙ্করের আবহাওয়া সঙ্গীত আরোপিত,চলচ্চিত্র “পথের পাঁচালী”-র অন্যতম চরিত্র “দুর্গা”-র চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন এক অনন্যসাধারণ ভুমিকায়, বাস্তবতায়।
পথের পাচালী,সেই চলচ্চিত্র, যে সিনেমা ভারতবর্ষ-এর সিনেমাকে আজ থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগে আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
কিংবদন্তি চিত্র পরিচালক সত্যজিতের অমর চলচ্চিত্রের চিন্তানন্দনতাকে আজও সারা পৃথিবী সেলাম করে।সত্যজিৎ রায় “পথের পাঁচালি”-তে “অপু-দুর্গা”-র যে চরিত্র চিত্রায়িত করেছেন,তা চিরন্তন এবং কালজয়ী।
এই পরিচিত বাংলার শ্যমলীমা মায়ের মতো আদুরে,স্নেহের,ভালোবাসায়,ঝগড়াঝাটিতে তবুও এক অন্তরলীন আত্মীয়তায় সুখ দুঃখ,হাসি কান্নার,অভাব অনটনের মাঝে বসবাস করা গ্রামের আটপৌরে শাড়িতে কিশোরী দুর্গা, তার ছোট্ট ভাই অপুর হাত ধরে শরতের, আশ্বিনের কাশবনে ছোটাছুটি করে বেড়ায়,আপন মনের আনন্দের আবদারে,হঠাৎ বৃষ্টিতে দিদি দুর্গা ভিজে যায়,ভিজে যায় ভাই অপু, মায়ের প্রতিনিধি দিদি বুকে করে আগলে রাখে সন্তান সম ছোট্ট ভাইকে,সে এক পরম স্নেহ ভালোবাসার নকশীকাঁথা যেন পাতা থাকে দিদি দুর্গার বিশ্বময়ীর বিশ্বমায়ের ভিজে যাওয়া সেই আঁচলখানিতে।
দুই ভাই বোন রেল লাইনের ধার দিয়ে ছুটে যায় দুরের রেলগাড়ীর আওয়াজ পেয়ে। অবাক চোখে দুই ভাইবোন দেখতে যায় দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন। ভাইকে আদরের হাতে সাজিয়ে দেওয়া,খুনসুটি করা,ইত্যাদি ইত্যাদি, এসব দৃশ্য যেন কালের অমোঘ নিয়মে কোনোদিন বিবর্ণ বা মলিন হবার নয়।হবেও না। বরং এইসব দৃশ্যগুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষের মনে চির ভাস্বর হয়ে,জীবন্ত হয়েই থেকে যাবে অনন্তকাল। “Odd on a gracian earn” – এর মতো মানুষকে শেখাবে “beauty is truth,truth is beauty”.
কালের নিয়মে প্রকৃতি ও নর-নারীর অপরূপ সৌন্দর্য যেমন বিবর্ণ হতে হতে একদিন ম্লান হয়ে যায়,নিঃশেষ হয়ে যায়,তেমনই বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের দুর্গা তথা বাস্তবের দুর্গা ওরফে কলকাতার যাদবপুরের, যাদবপুর বিদ্যাপীঠের শিক্ষয়িত্রী উমা দাশগুপ্তা(বিয়ের পরে পদবী সেন),৮৪ বছর বয়সে চলে গেলেন অমরত্বের সন্ধানে।রেখে গেলেন ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করা ” অপু”(সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়) কে। রেখে গেলেন সিনেমায় অভিনয় করা ছোট্ট দুর্গা (শম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়-কে,ইনি পথের পাঁচালীর মা সর্বজয়ার ভুমিকায় অভিনয় করা অভিনেত্রী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কন্যা)-কে।
সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি দুর্গার বয়স বাড়ে না। সে চিরকাল প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এই বাংলা তথা সারাবিশ্বের এক কিশোরী,এক স্নেহশীলা জননীর প্রতিনিধি দিদি। তাই কখনো কোনও দিনই দুর্গার ভাসান নেই, ভাসান হয় না। তাই,উমা দাশগুপ্ত (সেন) রয়ে যান আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় চিরকাল।
অন্তিমে প্রার্থনা করি তিনি যেখানেই থাকুন,তিনি যেন ভালো থাকুন। তাঁর প্রতি রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম।