পৃথিবীর সেরা বই “আঙ্কেল টম’স কেবিন”, এবং কিছু অজানা কথা…

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

সারা পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২৫ টি বইয়ের মধ্যে অন্যতম বই হোল “আঙ্কেল টম’স্ কেবিন”.. বাংলায় অনুবাদিত নাম হলো.. ” টম কাকার কুটির”। এই বইয়ের লেখিকা হলেন হ্যারিয়েট এলিজাবেথ বীচার স্টো। সারা বিশ্বের সমস্ত ভাষায় এই বইটি অনুবাদ করা হয়েছে। এই বই পড়েনি,এমন মানুষের সংখ্যা সারা বিশ্বে খুবই নগণ্য।

কারন এই বই পড়েছিলেন স্বয়ং আব্রাহাম লিঙ্কন,ম্যাক্সমুলার,ম্যাক্সিম গোর্কি,মোপাঁসা,জর্জ বার্নাড শ,টমাস আলভা এডিসন, এলবার্ট আইনস্টাইন,মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ),ভগিনী নিবেদিতা,মাদার টেরিজা,সুভাষচন্দ্র বসু,জগদীশ চন্দ্র বসু,বারট্রান্ড রাসেল,জন এফ কেনেডি, ডঃ মার্টিন লুথার কিং,নেলসন ম্যান্ডেলা,সহ সারা বিশ্বের সকল নোবেলবিজয়ী ব্যক্তি,এবং লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ বিভিন্ন প্রজন্মের,বিভিন্ন সময়ের।

এই বই এমন একটি বই যা এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদের দলিল। এর লেখিকা হ্যারিয়েট বীচার স্টো ১৮১১ সালের ১৪ই জুন আমেরিকার লিচফিল্ড,কানেকটিকাটে ফ্লোরিডায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা ছিলেন রেভারেন্ড লেম্যান বীচার,আর মায়ের নাম ছিল রোক্সানা ফুডি বীচার।

সেই সময়ে আমেরিকার প্রায় সব জায়গাতেই ছিল এক চরম অমানবিক সামাজিক প্রথা,যার নাম দাসপ্রথা। কালো কালো মানুষদের ওপরে দাসেদের শ্বেতাঙ্গ মালিকরা চালাতো অকথ্য অত্যাচার খুন, ধর্ষন ইত্যাদি ইত্যাদি। সাউথ ক্যারোলিনা,মিসিসিপি,ফ্লোরিডা, জর্জিয়া,আলবামা,আরকানসাস,ভার্জিনিয়া,সহ বিভিন্ন জায়গায় এই প্রথা চলতো দিনের পর দিন, বছরের পর বছর।সাদা চামড়ার মানুষের অত্যাচারে প্রায় প্রতিদিন তামাটে,কৃষ্ণবর্নের কালো মানুষদের খুন হতে হোত। সূর্য ওঠার সাথে সাথে কাজ করতে হতো সূর্য ডোবা অবধি। খাওয়া, শোওয়া, বিশ্রাম, সবেতেই ছিল দাস মালিকদের কৃপনতা।

এই অমানবিক ঘটনা স্টো ছোট বেলা থেকেই দেখেছিলেন। সেইসব ঘটনা তাঁর মনে গভীর দাগ কেটেছিল। তিনি যখন কিশোরী, তখন এইসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেন। এঁদের আন্দোলন ছিল এই দাসপ্রথার অবলুপ্তির জন্য। এইসব দাস শ্রমিকদের মুক্তি,স্বাধীনতার কাম্যতাই ছিল এঁদের একমাত্র লক্ষ্য।তাই এঁদের বলা হোত Abolutionist/(এবোলুশনিস্টস)।

“আঙ্কেল টম’স কেবিন” বইটি পড়ার পরে ১৮৬১সালে আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মিঃ জন আব্রাহাম লিঙ্কন-এর সাথে হ্যারিয়েট এলিজাবেথ বীচার স্টো-এর দেখা হয়েছিল। আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছিলেন.. “আপনিই সেই মানুষ, যিনি অত্যাচারিত অসহায় মানুষের জন্মগত স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন আপনার এই বইয়ের মাধ্যমে।যার ফলশ্রুতিতে আজ সারা আমেরিকায় মুক্তিযুদ্ধের, গৃহযুদ্ধের জন্ম হয়েছে…,আপনার কাছে সারা আমেরিকা সহ এই পৃথিবী চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে…”। উল্লেখ্য,১৮৬১ সালে আমেরিকার সেই গৃহযুদ্ধের কারন ছিল এই দাসপ্রথার থেকে মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা।

১৮৫২ সালে “আঙ্কেল টম’স কেবিন” বই আকারে প্রকাশিত হয়।প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথেই তিরিশ লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। সে এক ইতিহাস।

এই বই লেখার পেছনে এক বাস্তব সত্য ইতিহাস আছে।সেটা হোল,স্টো যেমন নিজে দেখেছিলেন কালো নিগ্রো মানুষের ওপরে,রেড ইন্ডিয়ানদের ওপরে অকথ্য অত্যাচারের ঘটনা, ঠিক তেমনি তিনি নিজে কয়েক হাজার দাস শ্রমিকের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেছিলেন।এর পাশাপাশি তিনি সেই সময়ের কিছু দলিল পড়েছিলেন।তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোল জোশিয়া নামে এক দাসশ্রমিকের কাহিনী।

তার আগে আমাদের জানা দরকার, যে সেই সময়ে আমেরিকায় একটি আইন করা হয়েছিল,যে আইনের মাধ্যমে অত্যাচারিত দাস শ্রমিকের ওপরে চাবুক মেরে মেরে তার গা দিয়ে ফেটে বেরিয়ে আসা রক্ত চাটানো হতো, শোঁকানো হতো মালিকের পোষা শিকারী কুকুর দিয়ে।এরপর যদি কোনো দাস শ্রমিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে যেত,তখন এই শিকারী কুকুরদের লেলিয়ে দেওয়া হতো তাদের পেছনে।কুকুরগুলো তাদের কামড়ে,আঁচড়ে ধরে নিয়ে আসতো মালিকের ডেরায়,মালিকের কাছে। এর বিরুদ্ধে কেউ কোনও প্রতিবাদ করতে পারতো না।এই আইনকে বলা হতো “blood hound law” ( ব্লাড হাউন্ড ল)।মারাত্মক কালা আইন ছিল সেটা। এর বিরুদ্ধে স্টো লড়াই চালিয়েছিলেন অবিরাম ভাবে।

সেই সময়ে স্টো-এর হাতে আসে একটি দলিল..তার নাম ছিল ” The life of joshia hensen,formerly a slave,now an inhabitant of Canada,as narrated by himself”(দ্য লাইফ অফ জোশিয়া হেনসেন,ফরমারলি এ স্লেভ,নাউ এন ইনহ্যাবিট্যান্ট অফ কানাডা, এজ ন্যারেটেড বাই হিমসেল্ফ)।

এই জোশিয়া হেনসেন ছিলেন আমেরিকার মেরিল্যান্ডের একটি তামাক ক্ষেতের মালিকের ক্রীতদাস। অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনি ১৮৩০ সালে একদিন রাতের অন্ধকারে মাঠ,নদী,জঙ্গল পেরিয়ে পালিয়ে যান অন্টারিওতে। সেখানে তিনি দাসত্ব থেকে মুক্তি পান। জোশিয়ার কাহিনী ছাড়াও স্টো অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন
থিওডোর ডুইট ওয়েল্ড এবং গ্রিমকে সিস্টার্সদের লেখা “American slavery as it is..:Testimony of a thousands witnesses ” দলিল থেকেও।

দুনিয়া কাঁপানো এই বই “আঙ্কেল টম’স কেবিন” প্রথমে “the national era” ( journalists journals of abolutionist) সাপ্তাহিক পত্রিকাতে (১৮৪৭-১৮৬০) ৪০ কিস্তিতে প্রকাশ হয়েছিল ওয়াশিংটন ডিসি থেকে। প্রথম কিস্তি প্রকাশ হয়েছিল ৫ই জুন,১৮৫১ সালে। পরে “আঙ্কেল টম’স কেবিন’ বই হিসাবে প্রকাশ হয়েছিল ১৮৫২ সালের ২০ শে মার্চ।

আজও এই বইটি সারা বিশ্বে সমানভাবে সমাদৃত সকলের কাছে। আর এই বইটির স্রষ্টা লেখিকা হ্যারিয়েট এলিজাবেথ বীচার স্টোকে মনে রেখেছে মানুষ এক অনন্যসাধারণ শ্রদ্ধায়।

হ্যারিয়েট এলিজাবেথ বীচার স্টো ১৮৯৬ সালের ১লা জুলাই ফ্লোরিডায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মানব সভ্যতার এই মহীয়সী নারী কে আমরা স্মরণ করি শ্রদ্ধায়,কৃতজ্ঞতায় তার জন্মদিন আর মৃত্যুদিনের মাঝামাঝি আজকের দিনে।

Related posts

২৭ শে এপ্রিল মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো…

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

চৈত্র বৈশাখ মধুমাধবের মায়ায় মায়ায়