ইমনকল্যাণ সেন
লোকসভা ভোটের ফলাফল বেরনোর পর থেকেই খবরের শিরোনাম দিলীপ ঘোষ! কারণ, বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী কীর্তি আজাদের কাছে হেরেছেন তিনি। চেনা মেদিনীপুর আসন থেকে তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সুদূর বর্ধমান-দুর্গাপুরে। হারের পর দলের একাংশের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক মন্তব্য করছেন দিলীপ। আর তাতে যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছে সংবাদ মাধ্যম। ব্যাপারটা যেন এমন, দিলীপ ঘোষ তৃণমূলপ্রার্থীর কাছে হেরে যাননি, তাঁকে হারিয়ে দিয়েছে দলেরই একটা অংশ। অর্থাৎ, তৃণমূলের জয়কে যতটা বেশি ছোটো করে দেখানো যায়, তার থেকেও ছোটো করে দেখানোর প্রতিযোগিতা চলছে। আদতে কি তাই? দিলীপ ঘোষ কি অপরাজেয়? মেদিনীপুর থেকে তাঁকে সরিয়ে না দিলে তিনি কি এ বারও হারতেন না? বর্ধমান -দুর্গাপুরে দিলীপের পরিবর্তে বিজেপি যদি অন্য কাউকে (হয়তো বা অগ্নিমিত্রা পালকে) প্রার্থী করলে তিনি জিতে জেতেন? এমনই কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।
বিধানসভা ভিত্তিক ফল কী বলছে?
দুর্গাপুর পশ্চিম বিধানসভায় কীর্তি আজাদ ভোট পেয়েছেন ৮৫,৪৩০ টি । আর বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষ পেয়েছেন ৯৭,১১২ টি ।দিলীপ ঘোষ লিড পেয়েছেন ১১,৬৮২ ভোটে । দুর্গাপুর পূর্ব বিধানসভায় কীর্তি আজাদ পেয়েছেন ৮৫,৩৯০ ভোট, আর দিলীপ ঘোষ পেয়েছেন ৮৩,৬৯৭ ভোট । লিড পেয়েছেন কীর্তি আজাদ ১,৬৯৩ ভোটে । অর্থাৎ, দুটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্য়ে একটিতে দিলীপের লিড আর একটিতে হারের ব্যবধান দেড় হাজারের মতো। বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভার মধ্য়ে দিলীপের বলার মতো শুধুমাত্র এই দুই বিধানসভার ফলাফল।
বর্ধমান দক্ষিণ বিধানসভায় কীর্তি আজাদ পেয়েছেন ৯২,৬৯২ ভোট, সেখানে দিলীপ ঘোষ পেয়েছেন ৮৫,৪০৪ ভোট । লিড পান কীর্তি আজাদ সাত হাজারের বেশি ভোটে । মন্তেশ্বর বিধানসভায় কীর্তি আজাদ পেয়েছেন ১,১৩,৪৩৮ ভোট, সেখানে দিলীপ ঘোষ পেয়েছেন ৬৭,৬৯৬ ভোট । অর্থাৎ ৪৫,৭৪২ ভোটে লিড পান কীর্তি আজাদ । বর্ধমান উত্তর বিধানসভায় কীর্তি আজাদ ভোট পেয়েছেন ১,২৩,৩৬৮ ভোট, আর সেখানে দিলীপ ঘোষ পেয়েছেন ৬৭,৬৯৬ ভোট । কীর্তির লিড আসে ৫৫,৬৭২ ভোটে । ভাতার বিধানসভায় কীর্তি আজাদ পেয়েছেন ১,০৯,৫০১ ভোট, আর দিলীপ ঘোষ পেয়েছেন ৭৭,০৮১ ভোট । লিড পেয়েছেন কীর্তি আজাদ ৩২,৪২০ ভোটে । গলসি বিধানসভায় কীর্তি আজাদ ১,০৭,২৫০ ভোট, আর দিলীপ ঘোষ পেয়েছেন ৮৬৪৯৬ ভোট । কীর্তি আজাদ লিড পেয়েছেন ২০,৭৫০ ভোটে ।
কী ভাবে জয় কীর্তির?
বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে পাঁচ বিধানসভার ভোটাররা বিজেপির হিন্দুত্বকে পাত্তা দেননি, তাঁরা বেছে নিয়েছেন তৃণমূলের জনমুখী প্রকল্পকে । আর দুর্গাপুর শিল্প শহরে ভোটের ফল পরিষ্কারভাবে যে ছবি ফুটে উঠছে, তা হল শিল্পের দিক থেকে পিছিয়ে থাকা, শাসক দলের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, দুই বছর যাবৎ পুরনিগমের নির্বাচন না করা, নগরনিগমের সঠিক পরিষেবা না পাওয়া, জার্সি বদলু নেতাদের দলে গুরুত্ব দেওয়া, কর্মসংস্থান নিয়ে হতাশাগ্রস্থ নতুন প্রজন্মের ভোট এবং হিন্দিভাষী ভোট তৃণমুলের দিকে সেভাবে যায়নি । কিন্তু বিস্তীর্ণ গ্রামীণ অঞ্চলে সেটাই হয়েছে, যেটা সারা বাংলায় ঘটেছে। মেদিনীপুর ছেড়ে দিলীপ ঘোষ বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন বলে বর্ধমান-দুর্গাপুর তো আর বাংলার বাইরে চলে যায়নি। সারা রাজ্যে ভোটের ফলাফলের সঙ্গে সাযুজ্য স্পষ্ট বর্ধমান-দুর্গাপুরের ফলাফলেও।
একাংশের মতে, ভোটের আগে বিজেপির ঝড় উঠেছিল রাজ্যে। তবে, সেটা উৎসস্থল যে ‘গদি মিডিয়া’, তা আর খুলে বলতে হয় না। বুথফেরত সমীক্ষাতেও তাদের মুখোশ খুলে পড়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে,তৃণমুল বিরোধী হওয়াকে এক ফোঁটাও পাত্তা দেননি বর্ধমান-দুর্গাপুরের বৃহত্তর অংশের ভোটাররা। আর গ্রামীণ ভোটারেরা মুখ্যমন্ত্রীর জনমুখী প্রকল্পের সুফল পেয়েছেন বলেই ভোটের বাক্সে তার প্রভাব পড়েছে। কৃষক বন্ধু,স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, গ্রামীণ ভোটারদের উপরে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে । তাই তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে দুহাত উজাড় করে ভোট দিয়েছেন।
বাতাসে চক্রান্তের গন্ধ!
বর্ধমান-দুর্গাপুরে হেরে যাওয়ার পরেই দিলীপ ঘোষ দলের অন্দরে তাঁর বিরুদ্ধে ‘কাঠিবাজি’র অভিযোগ করেছিলেন। মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাকে যে কাঠি করে মেদিনীপুর থেকে সরানো হয়েছে, সেটা তো সকলেই জানে!’’ তাঁর বিরুদ্ধে ‘চক্রান্ত’ হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। সরাসরি কারও নাম না নিতে না চাইলেও তাঁর মন্তব্যে দল যে অস্বস্তিতে, তা সহজেই বোধগম্য। দিলীপ বলেছিলেন, ‘‘আমি হারিনি। বিজেপি হেরেছে। আমাকে হারাতে গিয়ে মেদিনীপুর আসনটাও হাতছাড়া হয়ে গেল! আগে দল কী সিদ্ধান্ত নেয় দেখি, তার পরে আমি আমার সিদ্ধান্ত নেব।’’
কিন্তু এখন নিজের হারের জন্য দিলীপ ঘোষ যদি কাঠি-তত্ত্বের আবিস্কার করেন, সেটা তাঁকে আত্মতৃপ্তি দিতেই পারে। বর্ধমান-দুর্গাপুর বাদে রাজ্যের আর ২৮টা লোকসভা কেন্দ্রে ঠিক যে ভাবে ভোটাররা বিজেপিকে পরাস্ত করেছেন, দিলীপ ঘোষের হারের পিছনেও সেই একই কারণ। দিলীপ বা তাঁর অনুরাগী মিডিয়া যদি সে কথা মানতে চান, বাংলার মানুষের তাতে কিছু যায়- আসে না। তাই বলে দলের একাংশের বিরুদ্ধে দিলীপের লাগাতার বিষোদ্গারকে মানুষ যে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবেন না, সেটাও না হওয়ার নয়!
বিশেষ করে, বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্র থেকে দিলীপ ঘোষের নাম ঘোষণা হতেই তিনি যেসব মন্তব্য করেছিলেন, সেগুলো এখনও অনেকের কানে বাজছে। তিনি বলেছিলেন, ‘বর্ধমানের পিচ আমার। আমিই ব্যাটসম্যান। প্রথম বলে ছক্কা আমিই মারব।…বর্ধমানের মাঠঘাট সবই চেনা। এখানকার মানুষ আমায় ভালবাসে সুতরাং বর্ধমান দুর্গাপুর লোকসভা বিজেপির হাতে মুঠোয়।’ ফলে এখন হেরে গিয়ে মেদিনীপুর থেকে সরিয়ে হারিয়ে দেওয়ার ‘গল্প’ বলে বিনোদনের রসদ জোগানো ছাড়া আর অন্য কিছুই হবে না!