পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
আমরা বাঙালী তথা ভারতীয়রা আত্মবিস্মৃত জাতি, একথা অনস্বীকার্য। তা না হলে,আমাদের সুপ্রাচীন এবং ঐতিহ্যময় এক পরম্পরাগত দেশের মানুষের কাছে সে দেশের অতীত ইতিহাস সংস্কৃতি সঠিকভাবে আজও উপস্থাপিতই করা হয়নি,এবং করা হয়ও না।
আমাদের দেশের ২০০ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে বুকের রক্ত দিয়ে,আত্মবলিদানের বিনিময়ে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য যে সমস্ত বীর বিপ্লবীরাএকদিন এদেশের আকাশে বাতাসে ঝড় তুলেছিল,তাদের কথা আমাদের সঠিকভাবে জানানো হয়নি,তাই তাদের কথা দেশের মানুষ মনেই রাখেনি।
তেমনই এক বিপ্লবীর কথা আমাদের আজ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হবে,কারণ ৩০শে জুলাই তিনি এই বাংলার মেদিনীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৮২ সালে। তাঁর নাম সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তিনি ছিলেন মনিষী রাজনারায়ণ বসুর ভাইপো। বাবার নাম ছিল অভয়াচরন বসু।আদি বাড়ি ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বোড়ালে। রাজনারায়ণ বসু ছিলেন বিপ্লবী ও ঋষি অরবিন্দের মাতামহ।তাই সেই সুত্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন অরবিন্দের সম্পর্কে মামা।যদিও বয়সে অরবিন্দের চেয়ে ১০/১১ বছরের ছোট ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ।
হেমচন্দ্র কানুনগো এবং সত্যেন্দ্রনাথ গোপনে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন মেদিনীপুরে। সেই সংগঠনের নাম ছিল ছাত্র ভাণ্ডার। এই সংগঠনে পরে সত্যেন্দ্রনাথ নিয়ে আসেন ক্ষুদিরাম বসুকে।তাকে বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত করেন সত্যেন্দ্রনাথ।
১৯০৭ সালে বিপ্লবী কর্মকান্ডের সমস্ত গোপনীয়তা বিশ্বাসঘাতকতা করে নরেন গোঁসাই নামে দলেরই একজন সদস্য।
সে রাজসাক্ষী হয়ে দলের সব গোপন কথা ব্রিটিশ পুলিশের কাছে বলে দেয়।ফলে গ্রেপ্তার হন অরবিন্দ, বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু,কানাইলাল দত্ত,প্রমুখ বিপ্লবীরা।
বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাই কে জেলের মধ্যেই চরম শাস্তি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
জোগাড় করা হলো অস্ত্র।সাজানো হোল ছক। নরেনের কাছে সত্যেন্দ্রনাথই খবর পাঠালেন যে সত্যেন্দ্রনাথও রাজসাক্ষী হতে চায়।তাই জেলের মধ্যে গোপনে সত্যেন আর নরেন…দুজনে প্ল্যান সাজাবে।ব্যাস, তারপর প্ল্যানমতন কাজ হবে।
এইভাবে নরেন গোঁসাইকে সত্যেন এবং কানাইলাল নিজেদের আওতায় এনে একদিন জেলের মধ্যেই গুলি করে বিশ্বাসঘাতকতার চরম শাস্তি দেয়।যথারীতি ইংরেজ পুলিশের হাতে দুজনেই ধরা পড়ে যায় এবং শুরু হয় বিচার।
কিন্তু সেই বিচারের মঞ্চে বীর বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু সেদিন দৃপ্ত সুদৃঢ় কন্ঠে বলেছিলেন,”আমি ইংরেজের আদালতে কোনো বিচারের প্রত্যাশা করিনা। দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে আমিই গুলি করে হত্যা করেছি, আমার কবে ফাঁসি হবে তাই জানতে চাই।”
ভাবা যায়, কি অকুতোভয়, কি বলিষ্টতা। দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেদের অমূল্য প্রাণ অবহেলায় আত্মবলিদান দিয়ে গেল যারা,তাদের আজ আমরা চিনিনা,জানিনা,এ আমাদের চরমতম লজ্জা,অপরাধ।
তখনও আমাদের দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে,দেশের মুক্তি সংগ্রামের ময়দানে গান্ধী, নেহেরু-দের জন্মই হয়নি। অবশ্য এদের তৈরি করেছিল ব্রিটিশ শক্তি নিজেদেরস্বার্থে, নিজেদের আধিপত্য এদেশের শাসনের ওপরে কায়েম করে রাখার জন্যে।কারন কংগ্রেস-এর জন্মই তো হয়েছিল ১৮৮৫ সালে,ব্রিটিশের তত্ত্বাবধানে অগাস্টাস হিউমের নেতৃত্বে।
যাইহোক, ১০ই নভেম্বর, ১৯০৮ সাল,আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে কানাইলাল দত্তের ফাঁসি হয়। আর, ২২ শে নভেম্বর, ১৯০৮ সালে প্রেসিডেন্সি জেলে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ফাঁসি হয়।
সেদিন উত্তাল হয়ে উঠেছিলো বাংলা। জেলের বাইরে কাতারে কাতারে মানুষ।ব্রিটিশ রাজ ভয়েতে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অন্তিম সংস্কার জেলের ভিতরেই সমাধা করেছিল।
৩০শে জুলাই ভারতবর্ষের তথা বাংলার অগ্নি সন্তান সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্মদিন।
তাঁকে প্রণাম জানাই। প্রণাম জানাই আর এক অগ্নি সন্তান কানাইলাল বসুকে।
যারা মুক্তির মন্দির সোপানতলে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছিল এই দেশের স্বাধীনতার জন্য,… “জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন”” ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান… “সেই আগুনের সুস্নাত বীর বিপ্লবীদের আমরা ভুলে গেলে আমাদের জন্মকেই ভুলে যাওয়া হবে। তাদের কাছে তাই আমাদের আজন্মের সমস্ত ঋণ আমরন বাঁধা পড়ে থাকবে। তাদের আমরা ভুলতে পারি কি?? না, পারিনা।