পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণের মধ্যে অন্যতম এবং অতি অতি প্রাচীন উৎসব হোল বাংলার আষাঢ় মাসের রথযাত্রা।
কবে প্রথম রথের উৎসব শুরু হয়েছিল,কেউ জানে না।
তবে রথের উৎসবের দুটি রূপ,একটি বহিরঙ্গের রূপ,আর অপরটি হোল অন্তরঙ্গের রূপ।
বহিরঙ্গের রূপ, সেতো আমাদের পরিচিত।আট থেকে আশি বছর বয়সের বাঙালি সেই উৎসবে সামিল হন।পথে পথে চলে তিন ভাইবোনের, বলরাম,সুভদ্রা আর জগন্নাথের বিগ্রহ দিয়ে ফুল পাতা মালায় সুসজ্জিত রথ,তার রশি থাকে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের হাতে।বাজে ঘন্টা,শঙ্খ,কাঁসর। রোল ওঠে “জয় জগন্নাথ “, ” জগন্নাথ স্বামী নয়নপথ গামী,ভবতু মে”। রথ উপলেক্ষে বসে মেলা,শহরে মফস্বলে, গ্রামে গঞ্জে। ভিড় জমে ওঠে মানুষের। সারিসারি পসরা নিয়ে বসে দোকান,হয় কেনাকাটা-বিক্রিবাটা,হাসিতে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে মানুষ।
“আমাদের জীবনতলায় ভিড় জমেছে,বসেছে রথের মেলা,দেখতে যাবো আমি তুমি”।
রথের মেলার বিবরণ পাওয়া যায়,বাংলা সাহিত্যে, কবিতায়, গানে গানে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই রথের মাহেশের মেলাতেই হারিয়ে যেতে দেখেছিলেন তাঁর “রাধারাণী” উপন্যাসের নায়িকা, রাধারাণীকে। গরিব কন্যার কাছ থেকে সব মালা কিনে নিয়েছিলেন৷ সেদিন অচেনা,অজানা এক ব্যক্তি। রাধারাণী সেই ব্যক্তির৷ মহানুভবতায় তার প্রতি ভালোবাসায়, কৃতজ্ঞতায় মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। পরে সেই ব্যক্তির সন্ধানে রাধারাণী অবশেষে খুঁজে পেয়েছিল তাকে–রুক্মিনী কুমার রায়-কে।
কালীপ্রসন্ন সিংহ ওরফে হুতোমপেঁচার লেখনিতে পাই,-” ছোট ছোট ছেলেরা বার্নিশ করা জুতো আর সেপাইপেড়ে ঢাকাই ধুতি পরে,কোমরে রুমাল বেঁধে,চুল ফিরিয়ে, চাকর-চাকরানিদের হাত ধরে,পয়নালার ওপরে পোদ্দারের দোকানে ও বাজারের বারান্দায় রথ দেখতে দাঁড়িয়েচে। মেলায় বিক্রি হত মাটির জগন্নাথ সুভদ্রা বলরাম, তালপাতার ভেঁপু, শোলার পাখি, নানান ধরনের রেশমি চুড়ি, জিলিপি, পাঁপড় ভাজা, আরও আরও সংসারের কতো জিনিস।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তো লিখেই ফেললেন,কি কি পাওয়া যেত রথের মেলায়? নাগরদোলা,গজা,নানান ধরনের মিষ্টি, ফুলুরি, তেলেভাজা, ঘুগনি, আলুরদম, লুচি, কচুরী, মিহিদানা, মিঠাই।মনিহারী দোকানে খেলনা বাঁশি, কাগজের কাঠের পুতুল, কাঠির ওপরে লাফ দেওয়া হনুমান, কট্ কটে ব্যাঙ, আরও কতকি।
রাজপথে চলত বিরাট বিরাট রথ,ভিড়ে ভিড়াক্কারে, মানুষ টানতো রথের রশি।
অবনীন্দ্রনাথ তো ছোট বেলায় রথের দিনে তালপাতার ভেঁপু কিনে বাজাতেন,নিজেই বলে গেছেন। সেযুগে বনেদি বাড়ির রথ ছিল পেতলের,অষ্টধাতুর,ভালো দামী কাঠের।সেইসব রথের আসনে বসে থাকতেন তিন ভাইবোন –জগন্নাথ সুভদ্রা বলরাম।নানা উপচারে সাজানো হোত তাদের।
আর এই রথের উৎসব চলতো,যা আজও চলে আটদিন ধরে –রথ থেকে উল্টোরথের দিন অবধি। লোককথায় বলে,জগন্নাথ রথের দিনে আসেন মাসীর বাড়ি,তারপর আটদিনের মাথায়,উল্টোরথের দিনে চলে যান নিজের বাড়ি।
এটা হোল বহিরঙ্গের রূপ।
আর অন্তরঙ্গের রূপ হোল– এই রথ হোল আমাদের শরীর। ভগবান প্রভু জগন্নাথদেব-এর রথ হোল আমাদের এই দেহখানি।এই মানব দেহ। জগন্নাথের রথ ২০৬টি কাঠ দিয়ে তৈরি, যা মানবদেহের ২০৬ টি হাড়ের প্রতীক। রথের ১৬ টি চাকা–৫টি জ্ঞানেন্দ্রিয়, ৫টি কর্মেন্দ্রিয়, ৬টি রিপুর প্রতীক। রথের রশি হোল মন।আর রথের সারথী হোল বুদ্ধি।এবং রথের রথী হলেন স্বয়ং ঈশ্বর, স্বয়ং প্রভু জগন্নাথদেব।
কঠোপনিষদ-এ লেখা রয়েছে–” আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু।// বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ।।(১/৩/৩)।।
আবার, আমরা পাই,শাস্ত্রে,– “অপানিপাদো জাবানো গ্রহীতাপশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্ণঃ/ সবেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তাত মাহুরগ্র্যং পুরুষং মহান্তম্।। (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ// তৃতীয় অধ্যায়)।।
এ এক অতি গভীর অনুভবের সাধনীয় সারসত্তার সারসত্য।
যা আমাদের মনকে,ভাবনাকে আরও আরও অনেক বিশাল অন্তহীন করে তোলে।আমাদের বিবেকের ঘটে নবজাগরণ। সেখানে থাকেনা আর কোনও সংকীর্ণতা, কূপমন্ডুকতা। শুচী অশুচীর সমস্ত সীমা পরিসীমা সেখানে জ্ঞানের পবিত্র স্রোতধারায় ধুয়ে মুছে যায়।
তখন রবীন্দ্রনাথ গেয়ে ওঠেন–” দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে,নইলে কি আর পারব তোমার চরণ ছুঁতে…”। তিনি উদাত্ত উচ্চারনে আমাদের পথ দেখান–” আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,/ বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া.।” রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি কাজী নজরুল ইসলামের লেখনীতেও সেই চিরন্তন জিজ্ঞাসাকে খুঁজে পাই–” বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবানের কোন্ সে জাত?// কোন্ ছেলের তাঁর লাগলে ছোঁয়া অশুচী হন জগন্নাথ?”
তাই এই বিশ্বের যে যেখানেই থাকুন, যে জাত ধর্মই তার হোক না কেন,তাঁর মধ্যেও বিরাজ করছেন বিশ্বপিতা জগন্নাথ। সেই বিশ্বমানবতার পায়ে, সেই বিশ্বমানবাত্মার পায়ে বিনম্র প্রণতি রেখে যাই।