পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
ভবিষ্য পুরাণে পাওয়া যায়, যে সূর্য আর শৃননু-র তিন সন্তান মনু,যম এবং যমুনা। এই যমুনা কার্ত্তিক মাসের শুক্লপক্ষ -এর দ্বিতীয়া তিথিতে ভাই মনু এবং যমকে আমন্ত্রন করে তাদের শুভকামনায় একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন, ভাইদের কপালে আয়ুতিলক পরিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের মঙ্গল কামনায়। সেই থেকেই হয়তো এই ভাইফোঁটা রীতির শুরু।
আবার ইতিহাসে পাওয়া যায়, যে শ্রীকৃষ্ণ জ্যোতিষপুর (এখনকার আসাম)-এর নৃকান্তাসুর বা নরকাসুরকে বধ করে ফিরেছিলেন দ্বারকায়,সেখানে উপস্থিত ছিলেন বোন সুভদ্রা। এই সুভদ্রা ভাই শ্রীকৃষ্ণকে বিজয়তিলক পড়িয়ে দিয়েছিলেন এই তিথিতে।সেই থেকেই নাকি ভাইফোঁটা রীতির সুত্রপাত।
১৪ দশ শতাব্দীতে সর্বানন্দ সূরী নামে এক পন্ডিতের লেখা পুঁথি “দীপোৎসবকল্প” তে পাওয়া যায়, যে, জৈন ধর্মের মহাতীর্থঙ্কর মহাবীর বর্ধমান-এর দেহত্যাগের পরে তাঁর বন্ধু এবং অনুসারী রাজা নন্দীবর্ধন শোকে মুহ্যমান হয়ে আহার নিদ্রা পিপাসা সব ত্যাগ করে দিয়েছিলেন।রাজ্যশাসন করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেই রাজ্যের প্রজাদের অসহায় অবস্থা দেখে রাজার বোন অনুসুয়া,মতান্তরে শীতা, রাজার কাছে যান এবং রাজাকে স্বাভাবিক হয়ে পুনরায় রাজকার্য পরিচালনা করার অনুরোধ করেছিলেন। এবং তিনি রাজাকে এই দিনে রাজতিলক পড়িয়ে আবার রাজ্য শাসনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সময়টা ছিল খ্রীস্টপূর্ব ৫২৭ অব্দ।মানে আজ থেকে ২৬০০ বছরেও আগে।
সেই থেকেই নাকি এই ভাইফোঁটা রীতির শুরু হয়।এই রীতি তাই শুধু হিন্দুদের মধ্যেই নেই, জৈন, বৌদ্ধ, পারসিক, সকল মতের মানুষের সমাজেই প্রচলিত। আর শুধু বাংলাতে নয়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশেই এই ভাইফোঁটা প্রচলিত আছে। খুব উৎসাহের সাথেই এই সুন্দর অনুষ্ঠান পালন করা হয়। কোথাও ভাইফোঁটা নামে,কোথাও ভাইদুজ নামে, আবার কোথাও ভাই টিকা, যম দ্বিতীয়া, ভাইচাল্লম, ভাই বিছিয়া,ভাইপিচ্ছম,ইত্যাদি নামে নামে। ভারতের বাইরে নেপালে এই অনুষ্ঠানের নাম, ভাই-লগন।
যাইহোক এই ভাইফোঁটা আজ আমাদের সমাজে,আমাদের জীবনে এক অপরিহার্য অঙ্গ।
এই প্রসঙ্গে কিছু কথালাপ এখানে রাখছি। সময়টা ১৯৪০ সাল।আজ থেকে ৮৪ বছর আগে।স্থান কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। উপস্থিত ৮৬ বছরের ছোড়দি বর্ণকূমারী দেবী, এবং ৮০ বছরের ছোট ভাই রবীন্দ্রনাথ। দিনক্ষণ – ভাইফোঁটার দিন।
বিবরণ পাচ্ছি রবীন্দ্র স্নেহধন্যা রানী চন্দের লেখা “গুরুদেব” গ্রন্থ থেকে।
” গৌরবর্ণ একখানি শীর্ণ হাত শীর্ণতর আঙুলে চুয়া- চন্দন নিয়ে ভাই রবির কপালে কাঁপা কাঁপা হাতে ভাইফোঁটা দিলেন। করলেন আশীর্বাদ। অসুস্থ ভাইয়ের মাথায়,বুকে,হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন–“দ্যাখো রবু, তোমার এখন বয়স হয়েছে,এক জায়গাতে বসে থাকবে।অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবেনা, বুঝলে?”
দিদির কথা শুনে হেসে হেসে ভাই রবি ঠাকুর বললেন-“না না..,আর কক্ষনো ছুটে ছুটে যাবনা।বসে বসে যাব এবার থেকে..”। সেই শুনে দিদিও হাসতে হাসতে ভাইয়ের থুতনিতে আদর করে চুমু দিয়ে বললেন–“ভাই রুবু,তুমি বুড়োই হয়েছো,মোটেই বড়ো হলেনা।এখনো দুস্টুমি বুদ্ধি তোমার ভাই গেল না…।”
ভাইফোঁটা –এই দিনটি ভাইবোনের মধুর সম্পর্কের। আমাদের জীবনের নকশীকাঁথায় অম্লান হয়েই ছিল,আছে,থাকবে। আমাদের অন্তরে অন্তরে হাজার হাজার বছর ধরে তার পথচলা,এগিয়ে চলা। পুরাণ থেকে ইতিহাস অতিক্রম করে সমকালকে ছুঁয়ে তার পরিক্রমণ আজ মহাকালের আগামী পথের দিকে বহমান।
সেখানে জীবনের,স্মৃতিতে,মনের মণিকোঠায়,যাপনের নিত্যদিনের পথেরধারে হয়তো রয়ে যায় অনেক টুকরো টুকরো স্মৃতি। যার সারা শরীরে হয়তো থাকে আনন্দের উচ্ছ্বাস, আবার হয়তো কোথাও থাকে বুক ফাটা অব্যক্ত কষ্টের অনুভব।
হয়তো কোথাও ভাইবোন তাদের সম্পর্ক,স্বার্থ-এর চোরাবালিতে হারিয়ে যায় কোনও তৃতীয় পক্ষের মন্ত্রনায় এই দিনের সমস্ত আনন্দ,উচ্ছ্বাস। আবার কখনো কোথাও গুমরে গুমরে ঘুরে বেড়ায় এক মনখারাপের কান্না।আগের বছরেই ছিল যে দাদা,ভাই…সে আজ নাই।শুধু স্থির দৃষ্টিতে বিরাজিত ফটোফ্রেমে নিশ্চুপ,সামনে ভালোবাসার মালা,একটি জ্বলন্ত ধুপ। ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ঘুরে বেড়ায় একাএকা সবার মাঝে ছোট বোন অথবা দিদি। মনখারাপ করা ব্যথা বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখে,হাসিমুখে দায়িত্ব পালনের ব্যস্ততায় বোনের মন কেঁদেই চলে,স্মৃতির আঙিনায়। এই দিনে সেই বোনের বা দিদির শাড়ির আঁচল অথবা পরনের ওড়না জানে বেদনার অশ্রুজলের পরশখানি। হয়তো বা কোনও দিদিহারা বা বোনহারা দাদা বা ভাই জানে তার লুকানো চোখের জলের করুণ কথা ও কাহিনী।
কবি লর্ড টেনিশন বলেছিলেন -” Time marches on, but,Memory stays,…for rest of our days…”
সময় চলে যায় পথিকের মতো আপন গতিপথের পরিক্রমায়। রয়ে যায় আমাদের বাকী জীবনের জন্য শুধুমাত্র স্মৃতিখানি।
তবুও এইদিন ভাইবোনেদের দিন।আসে আর যায় হাসি কান্নার,সুখ দুঃখের নিত্যকালের আপন ছন্দ নিয়ে প্রতি বছর।
তাই ভালো থেকো ভাইফোঁটা,খুব খুব ভালোথেকো। ভালো থেকো ভাই দাদা,দিদি বোন, সব্বাই ভালো থেকো। ভালো থেকো হারানো দাদার,হারানো ভাইয়ের স্মৃতি নিয়ে সকল বোনেরা দিদিরা,ভালো থেকো।ভালো থেকো হারানো দিদির,হারানো বোনের স্মৃতি নিয়ে সকল ভাইয়েরা,দাদারা,ভালো থেকো।
বিনম্রতায় অভিনন্দন, শুভেচ্ছা এবং শুভকামনায় বেঁচে থাকুক ভাইফোঁটা।