পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
১৮৭৬ সাল। সে প্রায় আজ ১৫০ বছর আগেকার কথা। সিল্কের, সাটিনের, গরদের পোশাক পরে, সারা গায়ে সুগন্ধী পারফিউম মেখে ভুরভুর করে চারিদিক মাত করা গন্ধে সেজেগুজে প্রার্থীরা একের পর এক এসে হাজির হচ্ছে। বিরাট একটা হলঘরের এক ধারে বসার জায়গায় বসছেন। আর তাদের ভোট দিতে উপস্থিত হয়েছেন সম্পত্তি, লাইসেন্স, ইত্যাদির ট্যাক্স হিসাবে টাকা জমা দেন পুরসভায়, এমন পুরুষ ব্যক্তিরা হয়েছেন সেই ভোটের ভোটার। এই সংখ্যাটা ছিল ৪৯৯৪ জন। তাঁদের নাম নথিবদ্ধ করা হয়েছে ভোটার হিসাবে। লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ভোটাররা। তাঁদের এক একজনকে নাম ধরে ধরে ডাকা হচ্ছে, আর তখনকার কলকাতা শহরের পুলিশ কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ সাহেব জিজ্ঞাসা করছেন, “কাকে ভোট দেবেন?” গোপনীয়তার কোনো ব্যাপার নেই। ভোটার সরাসরি তাঁর পছন্দের প্রার্থীর দিকে আঙুল তুলে দেখালেন, কাকে তাঁর পছন্দ।
সেই ভোটে মানে এ দেশে, এ রাজ্যে সেই প্রথম ভোটে ব্যালট পেপার নেই, আঙুলে কালি লাগানো, ব্যালট বক্স ইত্যাদি ইত্যাদি ছাড়াই কিন্তু সেদিন কলকাতা দেখেছিল তার নাগরিক নিবাচন। ১৮৭৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর। তখনকার ছোটলাটসাহেব রিচার্ড টেম্পলারের উদ্যোগে আর বড় লাটসাহেব লর্ড রিপনের সমর্থনে কলকাতার পৌরসংস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম এদেশের ভোট। এই ভোট নিয়ে সাধারণের মধ্যে বেশ একটা নতুন উদ্দীপনা দেখা গেলেও আমাদের ববঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বা হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখরা এই ভোট ব্যবস্থাকে নতুন এক হুজুগ হিসাবেই সেদিন দেখেছিলেন।
নির্বাচন নিয়ে বাবুদের উৎসাহ এবং নাচানাচি নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের শ্লেষ-কটাক্ষের পাশাপাশি, পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি নিয়ে হেমচন্দ্র লিখেছিলেন দীর্ঘ ব্যঙ্গরসাত্মক কবিতা–“সাবাস হুজুক আজব সহরে”। তবে এই ভোটের প্রার্থী হয়েছিলেন সেকালের কলকাতার কয়েকজন বিশিষ্ঠ মানুষও। তাদের শিক্ষা, পেশা ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ভোটারদের সচেতন করার উদ্যোগ করা হয়েছিল প্রশাসনের তরফেই।
সেই কথাও হেমচন্দ্রের কবিতায়, যেখানে ভোটার এসে বলছে,–“বিদ্যের জাহাজ বুড়ো, বৃদ্ধের নবীন/ খ্রিস্টানের মুখপাৎ,চোখানো সঙ্গিন্/ আমার পছন্দ অই খ্রীস্টভেকধারী / সাপোর্ট-এ দিলাম ভোট জিতি আর হারি।”
এখানে উল্লেখ্য, সেই ভোটের অন্যতম প্রার্থী ছিলেন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এই কবিতায় প্রকাশ হয়েছে যে ভোটারের পছন্দ এখানে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়।
এর ৪ বছর বাদে, ১৮৮০ সালে সাউথ ব্যারাকপুর মিউনিসিপালিটির নির্বাচন নিয়ে ভোট উৎসবের আনন্দ আর সেই সঙ্গে ক্ষুরধার প্রতিদ্বন্দ্বিতার গুরুত্ব ক্রমশ বেড়ে চলার কথা শুনিয়েছেন যতীন্দ্রমোহন দত্ত (যম দত্ত)।
যেনতেন প্রকারেণ ভোটে জেতার জন্য ভোটারকে প্রভাবিত করা, আর সে জন্য খানাপিনার পাশাপাশি নগদনারায়ণের ভুমিকার কথাও জানা যায়। তবে, ভোটের লড়াই ব্যক্তিগত সম্পর্কে কোনও রকমের কালোছায়া ফেলতো না সেই সময়ে। বরং দেখা যেত ভোটের ফলাফল বেরোনোর পরে বিজয়ী এবং বিজিত পক্ষ উভয়েই একসঙ্গে বসে আনন্দ করতেন, খাওয়া-দাওয়া হতো।
আজ থেকে ১০০ বছরেরও আগে ১৯২৩ সালে প্রদেশিক আইনসভার নির্বাচনে ব্যারাকপুর কেন্দ্রে প্রবীণ নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলেন রাজনীতিতে নবাগত বিধানচন্দ্র রায়। হ্যান্ডবিল ছড়ানো হয়েছিল,প্রচারমুলক গান, ছড়া, মিছিল,ইত্যাদি ইত্যাদি প্রথম শুরু হয়েছিল।
আজ ১৫০ থেকে ১০০ বছর পরেও সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আমাদের বাংলা-সহ সারা দেশে।বিভিন্নধরনের নির্বাচন। হারা-জেতাটা কোনো ব্যাপার নয়। পরস্পর পরস্পরকে সম্মান দিয়ে কথা বলা,সম্প্রীতি, শান্তি বজায় রাখা, ইত্যাদি ইত্যাদি শুভ মানসিকতার যেন কোথাও কোনরকমের অপমান না হয়,এটাই আমাদের সকলের দেখা এবং মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। কারণ ভোট আসে ভোট যায়। প্রতিযোগিতায় হার-জিত থাকেই,এটা সকলেই জানি। কিন্তু নগরে, শহরে, মফস্বলে, গ্রামে প্রতিটি ক্ষেত্রেই যেন পরস্পর পরস্পরকে সম্মান দিয়ে আমরা আমাদের দেশের মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে পারি।
গতকাল (১ জুন, ২০২৪) এবারের লোকসভা নির্বাচন সবে শেষ হয়েছে।ফলাফল আগামী ৪ জুন। হার-জিত থাকবেই কিন্ত কোনোরকমের কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। এটাই আমাদের অনুরোধ রইল। সকলের জন্য শুভ কামনায়।