প্রথম পাতা প্রবন্ধ কেউ মনেই রাখেনি তাঁকে, আজও তিনি উপেক্ষিত! সার্ধ-শতবর্ষে ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী

কেউ মনেই রাখেনি তাঁকে, আজও তিনি উপেক্ষিত! সার্ধ-শতবর্ষে ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী

320 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

সারা পৃথিবী সেদিন এক অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল।আজ থেকে ১০০ বছর আগে–১৯২০-২২/২৩সালে। অকালে বহুজনের প্রাণ চলে গেছে। আমাদের এই বাংলায় মহাকবি সুকুমার রায় তাঁদের মধ্যে এক অন্যতম নাম।

কি সেই মহামারী? সেই মহামারী ছড়াতো(আজও ছড়ায়) স্ত্রী বেলেমাছির কামড়ে। এই মাছি থাকে আমাদের ঘরের আশেপাশে,দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে,সন্ধ্যে হলেই কামড়ায়। এই বেলেমাছির কামড়েই এই মহামারী মারণ রোগ — কালাজ্বরে এই ভারতের সংক্রমিত জায়গাগুলিতে ৯৫-৯৮শতাংশ রোগী সেদিন মারা গিয়েছিলেন।আফ্রিকা,দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে,ল্যাটিন আমেরিকার ব্রাজিল সহ দেশগুলোতে,ইউরোপের কয়েকটি দেশে সেদিন এই কালাজ্বরের মারাত্মক প্রভাব দেখা দিয়েছিল।অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছিল।

এই রোগের মোকাবিলায় সারাবিশ্বে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন স্তরে সকলেই উৎকন্ঠিত হয়ে উঠেছিলেন।তাদের মধ্যে রয়েছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরাও।

নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে আমাদের এই বাংলার কলকাতার বুকে ক্যাম্পবেল মেডিকেল কলেজের(আজকের নীলরতন সরকার হাসপাতাল) প্রফেসর ডাক্তার উপেন্দ্রনাথে ব্রহ্মচারী একটি প্রতিষেধক আবিষ্কার করলেন ১৯২০ সালে,এবং পরপর ৮/১০ জন কালাজ্বরের রোগীকে সেই প্রতিষেধক তাদের শরীরে ইন্টারভেনাস ইনজেকশন দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিলেন।
ফলস্বরূপ সেই রোগীরা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। সারা বিশ্ব জয়ধ্বনি দিতে লাগলো। ওষুধটির নাম ইউরিয়া স্টিবামাইন (urea stibamine)।ধন্য ধন্য পড়ে গেল চারিদিকে। ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ-এর এই আবিষ্কার বিস্তৃতভাবে প্রকাশিত হয়েছিল এ দেশের, বিদেশের বিভিন্ন সায়েন্স পত্রিকায়। তখন তাঁর বয়স ৪৮-৫০। আসলে তার জন্ম তারিখ সরকারী খাতায় ৭ই জুন, ১৮৭৫ হলেও, ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ বলতেন যে তিনি জন্মেছিলেন ১৮৭৩ সালের ১৯ শে ডিসেম্বর, বিহারের জামালপুরে। মা ছিলেন সৌরভ সুন্দরী দেবী,আর বাবা ছিলেন জামালপুর রেল হাসপাতালের ডাক্তার নীলমণি ব্রহ্মচারী।

উপেন্দ্রনাথের পড়াশোনা বিহারে,পরে কলকাতায়।তিনি ডাক্তারি এবং গবেষণার সুত্রে এখনকার নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে,আর.জি.কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, কলকাতার স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাঁর কালাজ্বরের প্রতিষেধক আবিষ্কার ছিল নীলরতন সরকার হাসপাতালের একটি ছোট্ট ঘরে,যেখানে সন্ধ্যের পরে জ্বলতো একটি কেরোসিনের লম্ফ। যদিও সেই ঘর আজ আর নেই, তখনকার ব্রিটিশ সরকার সেই ঘরের কোনও স্মৃতিই রাখেনি,আসলে তারা তাদের পদানত একটা জাতির একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে,সেটা কল্পনাও করতে পারেনি।

এই ধারণা নিছকই একটা শূন্যগর্ভ ধারণা নয়,তার প্রমাণ হিসেবে এবারে রাখছি ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর প্রতি কি বিরূপতা-অন্যায়,অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করা হয়েছিল বা দেখানো হয়েছিল তার কিছু ঘটনাবলী।

১৯২৯ সাল।ভারতবর্ষে তখন একমাত্র নোবেল পুরস্কারে পুরস্কৃত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৯১৩ সালে)। নোবেল পুরস্কার যাদের তত্ত্বাবধানে, সেই সুইডিশ অ্যাকাডেমির অথরিটি তাদের দু’জন উচ্চপর্যায়ের কমিটির সদস্যদের ( একজন- Hans Christian Jacobaeus/ হ্যান্স খ্রিশ্চিয়ান জ্যাকোব্স্, আর অপরজন হলেন,Goran Liljestrand/ গরান লিলজেস্ট্র‍্যান্ড) বললো,যে,ভারত থেকে নোবেল পুরস্কারের জন্য একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানীর নাম সুপারিশ করতে। তারা সবদিক বিচার বিবেচনা করে ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর নাম এক নম্বর বাছাই হিসাবে নোবেল কমিটির কাছে দিলেন,যুগান্তকারী ইউরিয়া স্টিবামাইসিন প্রতিষেধক এবং dermal leishmaniasis আবিস্কারের জন্যে। সেবছর কলকাতা থেকেও স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক ডাক্তার সুধাময় ঘোষও নোবেল পুরস্কারের জন্য ডাক্তার উপেন্দ্রনাথে নাম প্রস্তাব করে নোবেল কমিটির কাছে আবেদন পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য কারণে সে বছর ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেলেন না। একবারও বিবেচনা করা হয়নি,যে উপেন্দ্রনাথের ইউরিয়া স্টিবামাইসিন সারা বিশ্বে কত লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ রক্ষা করেছিল সেদিন সেই মহামারীর কালে।

এরপর,১৯৪২ সালেও উপেন্দ্রনাথের নাম আরও একবার নোবেলের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। সুপারিশ করেছিলেন Professor Dr.U.P.Bose( Medicine Dept, of Calcutta Medical College &Hospital),
Professor Dr. M. N. Basu( Anatomy Dept. Of Karmichel Medical College hospital /এখনকার R.G.Kar hospital),
Professor Dr. S.C.Moholanobish( Physiology Dept.of Karmichel Medical College hospital),
Professor Dr. Sudhamoy Ghosh( Physics and Chemistry Dept.of Scool of Tropical Medicine, Calcutta),
Professor Dr.C.C. Basu( Pathology Dept. Of Karmichel Medical College and Hospital).

অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি সেবারেও উপেন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কারে পুরস্কৃত হলেন না।যদিও ততদিনে সারা বিশ্বের সমস্ত দেশ ডাক্তার উপেন্দ্রনাথের প্রতিষেধককে মানুষের জন্য গ্রহন করে নিয়েছে,এবং মুক্তকন্ঠে প্রশংসা করেছিলো। তবু্ও সেই আবিষ্কারক নোবেল পেলেন না।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে ডাক্তার এডোয়ার্ড জেনার(পক্সের ভ্যাক্সিন আবিষ্কারক), লুই পাস্তুর(জলাতঙ্ক রোগের ভ্যাক্সিন আবিষ্কারক), আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং ( পেনিসিলিন আবিষ্কারক),প্রমুখদের সাথে একই আসনে বসানো যেতে পারে আমাদের ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীকে..কারন এঁরা সকলেই এই মানব সভ্যতার ইতিহাসে অসহায় অসংখ্য মানুষের প্রান বাঁচানোর জন্য তাদের গবেষণা চালিয়েছিলেন, এবং সফলও হয়েছিলেন।

জানিনা,কিন্তু,যখন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার ঐকান্তিক নিরলস প্রচেষ্টায় এবং যুক্তিতে উপেন্দ্রনাথকে রয়াল সোসাইটির ফেলো (ভারতে প্রথম) করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো,তার পরেই ১৯৪৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারিতে এক ঐতিহাসিক উপেক্ষিত আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানী ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ হয়তো অভিমান নিয়ে চলে গিয়েছিলেন চিরকালের জন্য “জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে”….।

এই মহান ঐতিহাসিক ব্যক্তির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে এই প্রতিবেদকের সবশেষে একান্ত অনুরোধ সহ আবেদন রেখে গেলাম– আমাদের এই বাংলায় যদি “ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী”-র নামে,এবং এশিয়ার,তথা ভারতের,তথা বাংলার প্রথম মহিলা চিকিৎসক “ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়”-এর নামে মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল তৈরী করা যায়,তাহলে তাঁদের প্রতি আমরা আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম,এইটা ভাবতে হয়তো আমাদের সকলেরই আন্তরিকভাবে খুব ভালো লাগবে।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.