প্রথম পাতা প্রবন্ধ “এসো মানুষ হও…” স্মরণীয় বরণীয় আবাহন

“এসো মানুষ হও…” স্মরণীয় বরণীয় আবাহন

293 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

আমাদের সামাজিক জীবনে এক অবধারিত অবক্ষয়ের ভিত্তিভূমি তৈরি হয়েছে বহুকাল আগে থেকে, এবং এই মুহূর্তে সেই অবক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবন অতিবাহিত করছি। আমাদের মনে এক অমোঘ দ্বন্দ্ব তৈরি করে চলেছে পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাব। তখন মনে হয় আমাদের শুভবুদ্ধির পরিচয় কি আমরা সত্যিই দিতে পারি? পারছি?

নিজেদের বিবেকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কি আমাদের চোখে চোখ রেখে বলতে পারি, বা পারছি, যে আমরা মানুষ, আধুনিক মানব সভ্যতার বাসিন্দা? শ্রেষ্ঠ জীব?

এইরকম একটা অবস্থায় আমাদের উচিত বারবার আমাদের সভ্যতার পরম্পরায় যারা স্মরণীয় বরণীয়, সেই সকল মানুষের অমৃতসুধা বাণী স্বরণ করা, আত্মস্থ করা, অনুসরণ করা। এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে রেখে যাওয়া। তাদের কাছে শুধু শুকনো উপদেশ নয়, নিজেদের উদাহরণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। আমরা জানি -example is better than advise… “।

এই প্রসঙ্গে বলা যায়, সাম্প্রতিক কালে এখন ভোট রাজনীতির এক জরাগ্রস্ত জাঁতাকলে পড়ে ধর্মের জাত জালিয়াতিতে মানুষ এবং তার মানবিকতা পদদলিত হচ্ছে, নিপীড়িত হচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে।

মানুষ আজ বড়ই বিপন্নতায়, মানুষ আজ মানসিকভাবে বড়ই বিষন্নতায়। এই সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম বড়ই প্রাসঙ্গিক। যে মানুষটি একই আসরে গাইতে পারতেন আগমনী গান, শ্যামা-সঙ্গীত, শ্রীকৃষ্ণ ভজন সঙ্গীতের পাশাপাশি ইসলামি ভক্তিগীতি সৃষ্টি করে। তিনিই সেই মানুষ যিনি স্বধর্মকে যেমন শ্রদ্ধা করেছেন অন্তর থেকে, পাশাপাশি অন্য ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা ছিল কাজী নজরুল ইসলামের এক সহজাত ঔদার্যবোধ। তিনিই লিখতে পেরেছিলেন.. “মহাকালের কোলে এসে গৌরী হোল মহাকালী..” আবার, তিনি লিখছেন–“আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন রূপ দেখে শিব বুক পেতে দেয়, যার হাতে মরণ বাঁচন..” এর মতো পরমাশ্চর্য শাক্ত গীতি, মায়ের গান। আবার সেই তিনিই গান লিখছেন, “যাবি কে মদিনায়, আয় রে ত্বরা করি…”, কিম্বা,” “রমজানের ঐ খুশীর শেষে,এলো খুশির ঈদ রে…” গানের মতো ইসলামী ভক্তিগীতি।

কাজী নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠে পরিয়ে দিয়েছিলেন এমনই সব গানের অক্ষরমালা। তিনি চেয়েছিলেন মানবের আন্তরিক সর্বাঙ্গীন মুক্তি, পূর্ণ মনুষ্যত্বের সর্বজনীন প্রতিষ্ঠা।

ধর্ম আর জাতপাতের নামে নানাভাবে নানাপ্রকার ভণ্ডামি, অত্যাচার, অবিচার, উৎপীড়ন এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধেই ছিল কাজী নজরুল ইসলামের যুদ্ধ। সেখানে তিনি অন্তহীন প্রেমানুভবে মহীয়ান। সেখানে, ” হিন্দু পুরাকথার অন্তরঙ্গে আন্তরিক ইসলামি প্রত্যয়কে জড়িয়ে এক সর্বভারতীয় জীবন ঐতিহ্যের লালন এবং উন্মোচন ঘটেছে কাজী নজরুলের সৃষ্টিতে।

ইতিহাস থেকে জানতে পারি, যে ১৯২৬ সালের এপ্রিলে তখনকার কলকাতায় ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অত্যন্ত বিচলিত হয়ে কাজী নজরুল লিখেছিলেন–“ধর্ম সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এই সত্য চিরদিনই বিশ্বের সকলের কাছেই সমান সত্য।”(ছুতমার্গ)।

তিনি অনুভব করেছিলেন যে গরীব মানুষের ধর্ম একটাই, আর তা হোল তার বেঁচে থাকার আকুল প্রাণমনে চেষ্টা। আর অপরদিকে আপন স্বার্থে ধর্মীয় উন্মাদনায় কিছু স্বার্থপর, স্বার্থাণ্বেষী সব সময়ে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ তার “ধর্মের অধিকার ” (সঞ্চয়,১৩২৩) শীর্ষক আলোচনায় বলেছিলেন, ধর্মের দোহাই দিয়ে কোনও জাতি যদি মানুষকে পৃথক করতে থাকে,এবং তার অধিকারকে সঙ্কুচিত করে,তাহলে সে জাতিকে হীনতার অপমান থেকে রক্ষা করার জন্য কোনও রাষ্ট্রনৈতিক ইন্দ্রজাল নেই। কাজী নজরুল ইসলামও এই ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ভন্ডামীর বিরুধ্বে জেহাদ ঘোষণা করে বলেছিলেন–“তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,/মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি।”

স্বামী বিবেকানন্দ আমাদের দেশের এই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা কূপমন্ডুকতা থেকে দেশকে,জাতিকে বাঁচাতে বলেছিলেন,” ওরে জাত ধুয়ে কি খাবি? তাই জাতপাত সব শিকেয় তুলে, আয় তোরা মানুষ হ’…এসো মানুষ হও”।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন –“যত মত,তত। পথ”। শ্রীমা সারদা বলেছিলেন –“রাখাল যেমন আমার ছেলে, আমজাদও তেমনই আমার ছেলে…”।

তাই সেই যত মত তত পথের শেষে বসে আছেন আমাদের বিশ্বময়ী বিশ্বমায়ের নকশীকাঁথা, ভালোবাসার আঁচলখানি, যেখানে আমরা “পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহভরা কোলে তব,মাগো বলো কবে শীতল হবো…কতদুর আর কতদুর বলো মা….” এই আর্তি, প্রার্থনা রেখে যাই।

তাই আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবন অতিবাহিত করতে করতে নিজেরা নিজেদের আত্মসমীক্ষায় নিজেদের গড়ে তুলি নিজেদের মধ্যে, আমরা ধীরে ধীরে মানুষ হই। মনুষ্যত্ব-এর প্রতি বিনম্র ভালোবাসা দিয়ে প্রণাম জানাই। সৃষ্টি হোক, জন্ম নিক আপন ছোট্ট ঘর থেকে বিশ্বদেউলে সকলকে আপন করে নেওয়ার মন।

রবীন্দ্রনাথের কথায়–“আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া…”। বা অতুলপ্রসাদ সেনের সেই বিখ্যাত গানের কথায়–“আমায় রাখতে যদি আপনঘরে,বিশ্বঘরে পেতাম না ঠাঁই…”

স্বামী বিবেকানন্দের কথায় — “আমি তোদের ধর্ম টর্ম বুঝিনা, কিন্তু সারা দেশটা ঘুরে,আমার হৃদয়টা অনেক বড়ো হয়ে গেছে, একটা অতল অসীম ভালোবাসার জন্ম হয়েছে আমার ভেতর..” (প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য)।

তাই রেখে গেলাম বিনম্র মিনতি, অনুরোধ, প্রার্থনা..। রেখে গেলাম ভালোবাসা আর ভালোবাসার জন্মভূমি, যত্নে রেখো তাকে।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.