পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
আমাদের পরম্পরাগত ঐতিহ্যের ভালোবাসার আরেক নাম শারদীয়া উৎসব। সেই শারদীয়া উৎসবের মধ্যে দাঁড়িয়ে আজ মুখোমুখি হলাম মাইকেল মধুসূদন দত্তের আর ফ্রান্ৎস্ কাফকা-র। সে এক মহাসন্ধিক্ষণের মহা সমাপতন।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত শারদীয়া উৎসব-এর প্রান্ত লগ্নের শেষ প্রহরে বিষন্নতায় বলেছিলেন, যে নবমী নিশি যেন না পোহায়। এই রাত পোহালেই আমাদের ঘরের আদরের উমা চলে যাবে কৈলাসে,তার বাপের বাড়ি থেকে। সমস্ত আনন্দ, উচ্ছ্বাস ম্লান হয়ে যাবে। মহাকবির অভিমানের কথার রেশ ঝরে পড়ে পরবর্তীতে লোকগানে ,..”নবমী নিশি রে,বুঝি তোর দয়া নাই রে…”।
এবার মুখোমুখি হই জার্মান সাহিত্যের কবি সাহিত্যিক ফ্রান্ৎস্ কাফকা-র। তখন কাফকা-র বয়স ৪০ (১৯২৩ সাল), একদিন বার্লিনের একটি পার্কে একা একা হাঁটছিলেন। হঠাৎ এমন সময়ে দেখলেন একটি ছোট মেয়ে হাপুস নয়নে কেঁদে কেঁদে কি যেন একটা খুঁজে চলেছে। কাফকা তাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন যে ছোট্ট মেয়েটি তার আদরের পুতুলটা হারিয়ে ফেলেছে, আর সে সেটাকে খুঁজছে। আর তার পুতুলটার জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছে তাই সে কাঁদছে। এই কথা শুনে কাফকা-ও তখন মেয়েটির সাথে তার হারানো পুতুলটা খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু অনেক খুঁজেও পেলেন না। মেয়েটি খুবই মনমরা হয়ে গেল। সে পুতুল না পেলে বাড়ি ফিরবেনা বলে বায়না ধরে কাঁদতে লাগলো। তখন তাই দেখে,কাফকা তাকে আবার পরেরদিন ঐ সময়ে পার্কের ঐ জায়গায় আসতে বললেন আর আবার দুজনে মিলে হারিয়ে যাওয়া পুতুলটা খুঁজে দেখবেন,যাতে পাওয়া যায় এই কথা বলে তাকে আশ্বস্ত করলেন।সে তখন বাড়ি গেল।
পরেরদিন মেয়েটি এলো, কাফকা-ও এলেন। আবার খোঁজাখুঁজি শুরু হল,কিন্তু হারিয়ে যাওয়া পুতুলটা পাওয়া গেলনা। মেয়েটির খুবই মন খারাপ। সে চুপচাপ হয়ে গেছে। তখন কাফকা ছোট্ট মেয়েটিকে আড়াল করে,একটা চিঠি পকেট থেকে বার করে মেয়েটিকে দিয়ে বললেন.. “এই চিঠিটা তোমার হারিয়ে যাওয়া পুতুলের লেখা।” মেয়েটি খুব খুশি হল।কিন্তু কি লিখেছে তার হারিয়ে যাওয়া পুতুলটা? তখন কাফকা বললেন যে, চিঠিতে পুতুলটা লিখেছে সেই মেয়েটিকে..”দয়া করে তুমি কেঁদো না। আমি পৃথিবীটাকে দেখতে বেরিয়েছি। আমি আমার রোমাঞ্চকর ভ্রমণকাহিনী তোমাকে নিয়মিত লিখে জানাবো..।”
এই কথা শুনে তো খুব খুশি মেয়েটি,আনন্দে নাচতে নাচতে বাড়ি যেতে যেতে কাফকা-কে বলে গেল, সে রোজ আসবে পার্কে, আর কাফকা-ও যেন আসে হারিয়ে যাওয়া পুতুলের বিশ্বভ্রমণ-এর কাহিনির চিঠি নিয়ে।
এইভাবেই শুরু হয়েছিল একটি কাহিনির, আর তা চলেছিল কবি-সাহিত্যিক কাফকা-র আমৃত্যু পর্যন্ত।
কাফকা-র সাথে রোজ দেখা হতো সেই মেয়েটির, আর রোজ একটা করে চিঠি কাফকা তাকে দিতেন, এবং বলতেন, সেই চিঠি পাঠিয়েছে ছোট্ট মেয়েটির সেই পুতুল-টি। কাফকা মেয়েটিকে পড়ে শোনাতেন তার হারিয়ে যাওয়া পুতুলের বিশ্বভ্রমণকালীন সময়ের নানান রোমাঞ্চকর কাহিনির বর্ণনা। আর সেইসব কাহিনী শুনে মেয়েটিও খুব খুশী হতো, আনন্দ পেতো।
কিন্তু এইভাবে তো বেশিদিন চলতে পারে না। তাই,বেশ কিছুদিন এইভাবে চলার পরে একদিন কাফকা একটি পুতুল কিনলেন, এবং সেটি মেয়েটিকে দিয়ে বললেন,–“সোনা,এই নাও,তোমার হারিয়ে যাওয়া পুতুলটা।” মেয়েটি পুতুলটা হাতে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করেই কাফকা-কে ফেরত দিয়ে বলেছিল,..”এই পুতুলটা মোটেই আমার হারিয়ে যাওয়া পুতুলের মতো দেখতে নয়..”। কাফকা তখন ছোট্ট মেয়েটিকে আর একটি চিঠি দিয়ে বললেন, দ্যাখো এই চিঠিতে তোমার পুতুল কি লিখেছে। তাতে লেখা ছিল.. “চারিদিকে ভ্রমণ করতে করতে আমি অনেক পাল্টে গেছি।” সরল শিশু মনে মেয়েটি সেই চিঠির কথা বিশ্বাস করে পুতুলটা বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে খুব আনন্দ করতে লাগল। আর কাফকা দুচোখ ভরে দেখতে লাগলেন, এবং ভাবতে লাগলেন অনেক সময়ে অনেক অসত্য অনেক সত্যের চেয়ে মূল্যবান হয়, আনন্দদায়ক হয়, এটাই জীবনের রীতি।
এর ঠিক এক বছর পরে, ১৯২৪ সালে কাফকা যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন এবং মারা যান। সেই ছোট্ট মেয়েটি জানতোই না,কে কাফকা,কি তার পরিচয়,কতো বড়ো মাপের একজন মানুষ তিনি,ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়েটি তার সংসারে আপন ছন্দে বড়ো হতে লাগলো।
তারপর, কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। মেয়েটি এখন অনেক পরিণত বয়সে পা দিয়েছে।নিজের জগতে সে আর সকলের মতো সুখে,আনন্দে থাকে।একদিন ঘরের বিভিন্ন জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে মেয়েটি হঠাৎ খুঁজে পেয়েছিল কাফকা-র দেওয়া সেই পুতুলটা। আর তার ভেতরে সে দেখতে পায় কাফকা-র স্বাক্ষর করা একটি চিঠি। সেই ছোট্ট চিঠিতে কাফকা লিখেছিলেন.. ” everything you love will probably be lost,but in the end, love will return in another way…”.
এখানেই আমাদের ভালোবাসার শারদীয়া উৎসবের অবধারিত ভাবে সাময়িক শেষ হয়ে যাওয়ার মধ্যেই রয়ে যাবে সেই ভালোবাসার শারদীয়া উৎসবের আবার এই বাংলায় মাঠ ঘাট ভালোবেসে ফিরে আসার প্রত্যাশার কথা, ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের ভালোবেসে তাদের প্রাণে মনে আনন্দে অপেক্ষা করার প্রতীক্ষার কথা। আমাদের ঘরে ঘরে আমাদেরই মেয়ে রূপে উমার আগমনীর আবাহনের সময় গোনার দিনক্ষণের হিসাব নিকাশ।
রবীন্দ্রনাথের কথায়..” ফিরে পাবার জন্যে বুঝি হারাই ক্ষণে ক্ষণে,ও আমার ভালোবাসার ধন…”। কাজী নজরুল ইসলামের কথায়…”তোমার মহাবিশ্বে প্রভু হারায় না তো কিছু..”।
আজকের কবি বিবস্বানের কথায় পাই..”চোখের আড়াল হলেও,মনের আড়াল কি কখনো কিছু হয়, সে তো মনের আকাশে নক্ষত্রের মতো জেগে রয়…”।
সকলে খুব ভালো থাকবেন।